স্বর্ণ নীতিমালার সুফল আসেনি ঘরে। খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এতে নীতিসহায়ক যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে সেগুলো অনেকটা কাগুজে সুপারিশেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ঘোষণার পাঁচ ও সংশোধনীর প্রায় দুই বছরেও মাঠপর্যায়ে এ নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। যদিও দেশের জুয়েলারি শিল্পের বিকাশ, চোরাচালান বন্ধ, বৈধ আমদানির সুযোগ সৃষ্টিসহ ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে খাতটিকে রপ্তানি পর্যায়ে উন্নীত করতে ২০১৮ সালে এই স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। যা আরও সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২১ সালে যুগোপযোগী করার চেষ্টা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে চরম অসহযোগিতার ফলে এ নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় নীতিনির্ধারণীতে নিয়ন্ত্রক ও তদারক প্রতিষ্ঠানগুলোর যারা দায়িত্বে ছিলেন এবং রয়েছেন, সম্ভাবনাময় জুয়েলারি শিল্পের গভীরতা তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। অনেকের মধ্যেই এমন ধারণা রয়েছে, স্বর্ণের ব্যবসা মানেই খারাপ কিছু। তাই এর বিকাশ দমিয়ে রাখতে চান। আবার আরেকাংশ দেশে অবৈধপথে স্বর্ণ প্রবেশের বিষয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছে।
বাণিজ্যিকভাবে দেশে বৈধ পথে আমদানিকে উৎসাহিত করা হয়েছে স্বর্ণ নীতিমালায়। অথচ খাতটির হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চাহিদার ৯০ শতাংশ স্বর্ণ আসছে চোরাইপথে। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, বৈধ পথে আমদানির নতুন উদ্যোগটি এখনো আগের ব্যাগেজ রুলের শক্ত বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। উচ্চহারের ভ্যাট, শুল্ক ও করভারই এর জন্য দায়ী। এতে স্বর্ণের কাঁচামালের উচ্চমূল্য তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যবসার উৎপাদন ও পরিচালন খরচও বেড়েছে। আর এর বিপরীতে অবৈধ স্বর্ণের কারবার বড় হয়েছে।
‘যখন মানুষ বৈধ পথে কিছু করতে না পারে, তখনই অবৈধ পথ খুঁজে বেড়ায়’—স্বর্ণ খাত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ক আলোচনায় তিনি বলেন, এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দেশে স্বর্ণের বৈধ সরবরাহ বাড়াতে হবে। তাহলে এ খাতে যে ধরনের জটিলতা আছে, পর্যায়ক্রমে তার সমাধান আসবে।
স্বর্ণের বৈধ সরবরাহ বাড়াতে কোন দেশ কী করেছে—তার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) প্রেসিডেন্ট ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, দুবাইয়ে গোল্ডের ওপর ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা রয়েছে। আর বাংলাদেশে স্বর্ণের কাঁচামাল, স্বর্ণালঙ্কার এবং শিল্প যন্ত্রপাতির ওপর ধার্য করে দেওয়া হয়েছে উচ্চহারের ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক। মূলত এ কারণেই দেশে স্বর্ণের চোরাকারবারি হচ্ছে, যা বন্ধ করতে পারে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিসহায়ক ভূমিকা।
বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সব ধরনের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০-৬০ শতাংশ। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রিতেও রয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট। আছে অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ। ফলে বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম অনেক বেশি পড়ে। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের এ পার্থক্য দেশে প্রায় দ্বিগুণ হয়। অথচ এর সবটাই বহন করতে হয় ক্রেতাকে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা।
বাজুসের তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণালঙ্কারের বিক্রি ৩০ শতাংশ কমে গেছে। বেড়েছে বিদেশ থেকে স্বর্ণালঙ্কার কেনার প্রবণতা। কিন্তু দেশে স্বর্ণের অতি উচ্চ দামের কারণে সম্প্রতি সরকার অনুমোদিত ব্যাগেজ রুলের প্রক্রিয়াটিরও অপব্যবহার হচ্ছে। চোরাচালানে জড়িত মাফিয়া চক্রটি ঢুকে পড়েছে ব্যাগেজ রুলের সুবিধায়ও। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০২২ সালে প্রায় ৫৪ টন (প্রায় ৪৬ লাখ ভরি) স্বর্ণ বাংলাদেশে আনা হয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি। এই স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার বেশিরভাগই হয়েছে মাফিয়া চক্রের কারসাজিতে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেইন কালবেলাকে বলেন, সমস্যাটি মূলত আমাদের আমলাতন্ত্রের মানসিকতায়। নীতিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনের সময় অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় যেভাবে জুয়েলারি শিল্প বিকাশে দেশ উপযোগী, সময় উপযোগী করা হবে বলা হয়েছে, নীতিমালায় তার প্রতিফলন ঘটেনি। আন্তর্জাতিক পদ্ধতিও অনুসরণ করা হয়নি। যে নীতিমালা এসেছে, তার বাস্তবায়ন পর্যায়েও আমরা বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতা, উদাসীনতা দেখছি।
তিনি জানান, স্বর্ণ নীতিমালার অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে স্বর্ণের সরবরাহ বাড়ানো। নামকাওয়াস্তে সেই আমদানির পথ খোলা হলেও রাজস্ব নীতি দিয়ে তার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে একদিকে বেড়েছে স্বর্ণের চোরাচালান, অন্যদিকে বৈধপথে আনা স্বর্ণবার বা এই দিয়ে তৈরি গহণাসামগ্রীর দাম বিশ্বের সবচাইতে বেশি পড়ছে।
খাত-সংশ্লিষ্টদের এ দাবির সঙ্গে অবশ্য একমত হতে পারেননি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক নীতি ও শুল্ক ভ্যাট প্রশাসন) মো. মাসুদ সাদিক। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আসলে তেমন নয়। যতটা সম্ভব সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও অপব্যবহার রুখতে ব্যাগেজ রুল সংশোধন করা হয়েছে। আগের বাজেটগুলোতেও কিছু কিছু উদ্যোগ ছিল। সব কিছু তো একসঙ্গে করা সম্ভব হবে না।’
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত দেশে স্বর্ণের চাহিদা তৈরি হয়েছে ৪৮ মেট্রিক টন বা ৪৮ হাজার কেজি বা ৪ কোটি ৮০ লাখ গ্রাম কিংবা ৪১ লাখ ২৭ হাজার ২৫৭ দশমিক ০৯৩ ভরির সমান। অথচ দেশে এর একরত্তিও উৎপাদন হয় না। ফলে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা কোথা থেকে কীভাবে পূরণ হবে, এখন পর্যন্ত তার সমাধান মেলেনি। আর এ কারণেই খাত-সংশ্লিষ্টরা বারবার সামনে আনছেন প্রসঙ্গটি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, দায়িত্বশীলদের মানসিকতায় পরিবর্তনটা জরুরি। কারণ, স্বর্ণের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশাল। পুরো ট্যাক্স ফ্রি না হোক, সহজ নীতি কাঠামো দিয়েও যদি খাতটির ওপর দৃষ্টি দেওয়া যায়, তাহলে শুধু জুয়েলারি খাত থেকেই প্রতিবছর সরকারের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসবে।
বাজুস সূত্রমতে, ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় স্বর্ণ আমদানির জন্য গোল্ড ডিলার নিয়োগের বিধান প্রবর্তন করে। বিধি মতে, গোল্ড ডিলার নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের মার্চে একটি সার্কুলার জারি করে। এতে আনুমানিক ৫০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক আবেদন করলেও সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় মাত্র একটি ব্যাংক ও ১৮ প্রতিষ্ঠানকে নবায়নযোগ্য দুই বছর মেয়াদি লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ডিলার ব্যাংক হিসাবে মনোনীত হওয়া মধুমতি ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো স্বর্ণ আমদানি করেনি। আবার প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে যে কয়জন আমদানির উদ্যোগ নেয়, সেখানে ব্যবসাবান্ধব সহনীয় নীতি অনুসরণের পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এরপরও অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড ১১ কেজি এবং আরোসা গোল্ড করপোরেশন ১৫ কেজি এবং জরোয়া হাউস লিমিটেড ২৫ কেজি স্বর্ণ আমদানি করেছে। তারাও আর দ্বিতীয়বার আমদানিমুখী হয়নি। অনুমোদিত বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও এক্ষেত্রে নাম সর্বস্ব ভূমিকায় থেকে গেছে। বাজুস সূত্রগুলোর দাবি, এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা কাজ করেছে। তদারকির দুর্বলতাও ছিল দৃশ্যমান। তবে এতে অবশ্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ এবং চলমান ডলার সংকট। এ অবস্থায় ব্যবসা বাঁচাতে স্থানীয় জুয়েলারি ব্যবসায়ীরাও এখন কম দামে স্বর্ণ কিনতে বিকল্প পথের খোঁজ করছেন।
এদিকে এতদিন বিদেশফেরত বাংলাদেশি নাগরিকদের মাধ্যমে বৈধ উপায়ে একজন যাত্রীর প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে তার ব্যাগে করে ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ দেশে আনার সুযোগ ছিল। নারী যাত্রীরাও পরিহিত অলঙ্কার সুবিধার আওতায় কিছু স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারেন। দেশে স্বর্ণের যত চাহিদা আছে, তার সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ শতাংশ আসছে ব্যাগেজ রুলস সুবিধার আওতায়। যা দেশের ডলারের সংকট ও ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার বন্ধে ২০২৩-২৪ অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্কহার ভরিতে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বর্ণ আনার পরিমাণ ১১৭ গ্রাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি হলে উদ্বৃত্ত স্বর্ণ বাজেয়াপ্তের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বৈধ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এড়াতে এই উদ্যোগকে বেশ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে বাজুস। স্বর্ণের জোগানের বাকি ৬ থেকে ৭ শতাংশ আসে পুরোনো স্বর্ণ থেকে, যা দোকানিদের কাছে ক্রেতারা বিক্রি করে থাকেন।
মন্তব্য করুন