দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘিরে আন্দোলনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে থাকা বিএনপি। দলটির লক্ষ্য, তপশিলের আগেই একদফার চলমান আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছানো। তবে তপশিলের পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকার তপশিল ঘোষণার মাধ্যমে দেশকে নির্বাচনমুখী করার কৌশল নিয়েছে। জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করতে পারলে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়তে পারে বলে সরকার ভাবছে। এ জন্য পাল্টা কৌশল হিসেবে তপশিলকে কেন্দ্র করে আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা নিচ্ছে বিএনপি।
জানা গেছে, তপশিলের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এই সময়ের মধ্যে ইতিবাচক কিছু না হলে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়টিও ভাবনায় রয়েছে বিএনপি ও শরিকদের। যদিও এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তারা। দলের কর্মকৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন এমন নেতারা অবশ্য মনে করেন, অসহযোগ আন্দোলন করার পরিস্থিতি এখন দেশে নেই। সরকারকে অসহযোগিতা করে কর্মস্থলে না যাওয়া, কলকারখানা বন্ধ রাখা কিংবা অফিস-আদালত বন্ধ রাখার মতো বাস্তবতা নেই। এর পরও তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকাতে অসহযোগ আন্দোলনেই যেতে হতে পারে বলে বিএনপি ও শরিকদের অনেকের অভিমত। সে কারণে এই কর্মসূচি একেবারে নাকচও করেননি তারা।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আগামীকাল শুক্রবার ভোর ৬টায় দেশব্যাপী তৃতীয় দফার অবরোধ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আন্দোলনের চতুর্থ ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। জানা গেছে, তৃতীয় দফার এই অবরোধ শেষে শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে আগামী সপ্তাহের প্রথম দুই দিন হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। ওই কর্মসূচি শেষে এক দিন বিরতি দিয়ে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কিংবা হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা তথা জনস্বার্থে শুক্র ও শনিবার ছাড়াও সপ্তাহে আরও এক দিন কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি ও শরিকদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, যতদিন না এ দেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে, ততদিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলতেই থাকবে। কাজেই মিথ্যা মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তার-আটকের মাধ্যমে এই জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, সরকার মনে করছে তপশিল ঘোষণা হলে বিরোধী দল কাবু হয়ে পড়বে। এটা দুরাশা মাত্র। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের তপশিল ঘোষণার উদাহরণ অনেক দেখেছি। তপশিল ঘোষণার পরে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন হয়েছে, সেই উদাহরণও অনেক দেখেছি। শুধু তাই নয়, তপশিল ঘোষণার পরে যে নির্বাচন হওয়ার কথা, তা বাতিল হওয়ার উদাহরণও আছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, একদফা দাবি আদায়ে আন্দোলনের যে ধারাবাহিক কর্মসূচি চলমান রয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে। আশা করি, বৃহস্পতিবার আন্দোলনের পরবর্তী ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারব। যুগপতের শরিকরা নিজ নিজ জায়গা থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তিনি বলেন, সহিংসতা বা নাশকতা এড়িয়ে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে আমরা যাতে জনগণকে যুক্ত করতে পারি, সেটাই আমাদের মূল মনোযোগের জায়গা। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত নৈতিক সমর্থন আছে বলেই হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হচ্ছে। চলমান আন্দোলনে আমরা আগামীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আরও ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করতে চাই। তারা কীভাবে আন্দোলনে রাজপথে নামবে, সেটা আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে। দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বীকৃত সব পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হবে বলে জানান গণতন্ত্র মঞ্চের এই নেতা।
ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামে বিএনপি ও শরিকরা। বিএনপির ওই মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের হত্যা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্দোলনরত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম দফায় ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টার এবং ৫-৬ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টা রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ মিত্ররা। এর আগে বিএনপির মহাসমাবেশে হামলার প্রতিবাদে পরদিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে হরতাল পালন করে তারা।
আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের এই কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, এখন পর্যন্ত অবরোধ ভালোভাবে পালিত হচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক মানুষের চলাচল বাড়লেও তা বেশি বলা যাবে না। এর মানে হচ্ছে, বিএনপির আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। তারা মনে করেন, মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদেই শুধু বাসা থেকে বের হচ্ছে। খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হচ্ছে না।
বিএনপি ও জোট শরিকদের কারও কারও আশঙ্কা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার, বিরোধীদের যেভাবে দমন-নিপীড়ন চলছে, তাতে অবরোধ অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া লাগাতার চললে একপর্যায়ে গিয়ে অবরোধের কর্মসূচি কার্যকর নাও থাকতে পারে। তাই বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আসা উচিত। একই সঙ্গে বিএনপির দলীয় কার্যালয় খোলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ রয়েছে। কার্যালয় এখন কার্যত পুলিশের নিয়ন্ত্রণে।
অবরোধের বিকল্প কর্মসূচি খুঁজতে গত এক সপ্তাহ ধরে স্থায়ী কমিটি ছাড়াও ঢাকা মহানগর বিএনপি, দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মতামত নেয় দলটি। তবে অবরোধের বিকল্প হিসেবে হরতাল ছাড়া বিএনপি ভিন্ন কোনো জুতসই কর্মসূচি এখনো খুঁজে পায়নি বলে জানা গেছে। দলের অধিকাংশ নেতা ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারাও বিএনপির হাইকমান্ডকে কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এদিকে চলমান আন্দোলন সফলে নতুন কৌশল গ্রহণ করছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে অবরোধ জোরদার করতে দলের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলটির মূল্যায়ন, চলমান অবরোধ কর্মসূচিতে ঢাকা অনেকটা বিচ্ছিন্ন আছে। জেলা পর্যায়ে অবরোধ আরও জোরদার করতে পারলে ঢাকা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি জোরদার করতেই সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের নিজ আসনে গিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
দলের এমন নির্দেশনা প্রসঙ্গে বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, অবরোধ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এ কাজটি সফলভাবে করতে হলে জেলা পর্যায়ের আন্দোলন আরও তীব্র করতে হবে। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ের সড়ক ও মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়টির ওপর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নজর দিচ্ছে বেশি।