যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নিবন্ধিত দুই শরিক জোট ছেড়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচন ইস্যুতে বাকি মিত্রদের ওপর আস্থা রাখতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, সবাই লোভী কিংবা ভীতু নয়। গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের স্বার্থে যুগপতে থাকা বাকি মিত্ররা তাদের নীতি ও আদর্শে অবিচল থাকবে বলে প্রত্যাশা বিএনপির। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিত্রদের ধরে রেখে একদফার চলমান আন্দোলন শক্তভাবে এগিয়ে নেওয়াই এখন দলটির লক্ষ্য। তাদের প্রত্যাশা, চলমান আন্দোলনে ‘একতরফা’ তপশিল বাতিল এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানতে সরকার বাধ্য হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একতরফাভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের চাপ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে বিএনপিও ‘একতরফা’ তপশিল প্রত্যাখ্যান করে
ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সরকার তৎপর।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার অনেক দিন ধরে যুগপতের শরিকদের লোভ, ভয়-ভীতি দেখিয়ে জোট ভাঙার চক্রান্ত করছে। এখন মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন (৩০ নভেম্বর) সামনে রেখে বিএনপিকে ভাঙা এবং তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দলকে নির্বাচনে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। সরকারি চাপ ও প্রলোভনে পড়ে যুগপতের দুই শরিক কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) জোট ছেড়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে মাঠে সক্রিয় অপরাপর বিরোধী দলগুলোকে ভোটে নিতে প্রতিনিয়ত নানা প্রলোভন ও চাপ সৃষ্টি করছে সরকার।
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে এই তৎপরতা বাড়ছে। সরকারের এই কৌশল ঠেকাতে বিএনপিও ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। যুগপতের দুই শরিকের নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণায় এই তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে যুগপতের নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আর কিছুদিন আন্দোলন চালিয়ে গেলে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে শিগগিরই পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে বলে শরিকদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে যথাযথ মূল্যায়নের পুনরায় আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যুগপতের বাইরে থাকা দলগুলোও যাতে নির্বাচন বয়কট করে, তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির তিন সদস্যকে দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এরই মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতে, এখন তাদের আন্দোলন যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে দলকে যেমন ভাঙতে পারবে না সরকার, তেমনি যুগপতের বাকি মিত্রদেরও আর বাগিয়ে নিতে সক্ষম হবে না। যুগপতের বাইরে থাকা নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোকেও আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচন সহযোগী করতে পারবে না। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং ছয়টি ইসলামী দলের মোর্চা ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’কেও নির্বাচনে নিতে পারেনি। বিএনপির প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগ সরকারের ‘একতরফা’ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না।
দশ দফার ভিত্তিতে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে দলটি। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামে বিএনপি ও এর মিত্ররা। বিএনপির অনেক নেতার মতে, মহাসমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যেতে তারা বাধ্য হয়েছেন। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ছয় দফায় দেশব্যাপী ১৩ দিন অবরোধ এবং দুই দফায় ৩ দিনের হরতাল পালন করেছে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা।
বিএনপির সঙ্গে ৪০টি রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে বিএনপিসহ ৮টি নিবন্ধিত দল রয়েছে। দুটি দল জোট ত্যাগ করে ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় এখন নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৬টি। বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো হলো—লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের দুই শরিক এবং যুগপতের বাইরের একটি দলকে নিয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণাকে তাদের ‘রাজনৈতিক ভুল’ বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তার মতে, জনগণ এটাকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। তারা যে ভুল করেছে, ভবিষ্যতে তা তারা বুঝতে পারবে।
যুক্তফ্রন্ট গঠন প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক কালবেলাকে বলেন, সরকার অনেক দিন ধরে যুগপতের শরিকদের লোভ-ভীতি দেখিয়ে জোট ভাঙার চক্রান্ত করছে। যারা দুর্বল, লোভী, তারা এতে পরাজিত হয়। কিন্তু আন্দোলন এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আমরা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন করছিলাম, তখন লিয়াজোঁ কমিটির মিটিং থেকে ক্যাপ্টেন আলীম চৌধুরী, কোরবান আলীরা উঠে গিয়ে এরশাদের সরকারে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যুগপৎ আন্দোলন তো থামেনি, এরশাদের পতনও তো আটকানো যায়নি। কল্যাণ পার্টি ও বিএমএল যুগপৎ থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজেদের জনস্বার্থ ও আন্দোলনবিরোধী স্বার্থলোভী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এতে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের কোনো ক্ষতি হবে না।
যুগপতের ‘নিবন্ধিত’ বাকি শরিকদের জোট ছেড়ে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো শঙ্কা আছে কি না, জানতে চাইলে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, আমরা জ্যোতিষী নই যে, এ বিষয়ে আগাম ধারণা দিতে পারব। তবে সরকার যে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তার অধিকাংশই অন্যায্য ও অপরাধমূলক। কিন্তু এসব কৌশলে সবাইকে তো পরাজিত করা যায় না। সবাই লোভী কিংবা ভীতু না। যারা রাজনীতি আন্তরিকভাবে করে, যাদের নীতিবোধ আছে, তাদের নীতি ও আদর্শ অবিচল থাকবে—আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। মঞ্চের সমন্বয়ক ও জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন কালবেলাকে বলেন, আমরা একটা ন্যায়সংগত আন্দোলন করছি। অন্যদিকে, অন্যায্য ও একতরফা নির্বাচন করতে একটা কেনাবেচার হাট বসানো হয়েছে। সেখানে কেউ কিছু উঠাবে এবং কেনাবেচা হবে—এটাই খুব স্বাভাবিক। তবে জনগণ এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ন্যায্য আন্দোলনের কাছে এসব আয়োজন, বেচাকেনার আয়োজন টিকবে না। বিএনপিকে ছেড়ে যুগপতের নিবন্ধিত অন্য শরিকদের নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপৎ জোটে এমন কোনো শঙ্কা ও সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। তবে বাগিয়ে নিয়ে, ছুটিয়ে নিয়ে বেচাকেনার কাজ তো হয়ই, অতীতেও হয়েছে। এটা আন্দোলনের ব্যর্থতা প্রমাণ করে না। বরং বাগিয়ে নেওয়া, প্রলোভন দেখানো এটা চরম অনৈতিকতার উপসর্গ। যারা অনৈতিকতার পথে চলে তারাই এসব উপসর্গ তৈরি করে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় আমরা বিএনপির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন বর্জন করেছি। এরপর আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়েছি। বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনেও আমরা যাব না। তা ছাড়া বর্তমান তপশিলে নির্বাচন যে হবে, সে গ্যারান্টি তো শতভাগ কেউ দিতে পারছে না। এখন যারা নির্বাচনে যাবে, মানুষ মনে করবে তারা হালুয়া-রুটি, টাকা-পয়সার বিনিময়ে গেছে। আমাদের প্রত্যাশা, একতরফা প্রহসনের নির্বাচনে অন্য কোনো দল যাবে না। বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন হলে আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নেব। বিএনপির পক্ষ থেকে এরেই মধ্যে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে যুগপতের মিত্রদের সবাইকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমরা বিএনপির ওপর আস্থা-বিশ্বাস রাখতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে জোটের এ সমন্বয়ক বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে জনপ্রিয়তা অনুযায়ী শরিকদের আসন দিয়ে মূল্যায়ন করেছে বিএনপি। তাহলে এখন শরিকরা কেন বিএনপিকে ছেড়ে হালুয়া-রুটির লোভে নির্বাচনে যাবে।