দেশে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকা আমদানি ব্যয় এখন অনেকটাই কমে এসেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ও আগের তুলনায় বেড়েছে। এর পরও দেশে ডলার সংকট কাটছে না। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবুও কাটছে না ডলার সংকট; বরং রিজার্ভ আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধানত পাঁচ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আপাতত দূর হচ্ছে না। এর প্রথমটি হচ্ছে প্রচুর অনিষ্পন্ন আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাপক আমদানির চাপও রয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর বিদেশ থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে অনেক অর্থ ব্যয় হবে। এ ছাড়া দেশ থেকে পাচারও বেড়েছে এ সময়ে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসা কমে গেছে। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সহসাই দূর হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর কালবেলাকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় না বাড়লে সহসাই কাটবে না ডলার সংকট। তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ায় ডলার সংকট কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। অনেক অনিষ্পত্তিকৃত এলসি আছে, আমদানির উচ্চ দায় পরিশোধের চাপও রয়েছে, অনেক স্বল্পমেয়াদি ঋণ আছে, যেগুলো এ বছরেই পরিশোধ করতে হবে। ফলে এতে বড় অঙ্কের ডলার বাইরে চলে যাবে। এ ছাড়া আরেকটি বড় কারণ অর্থ পাচার। নির্বাচনী বছরে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য যে পরিমাণ ডলার প্রতিবছর আসত, এখন তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, যতদিন পর্যন্ত না আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দুই সূচক রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স না বাড়বে, ততদিন ডলার এই টানাপোড়েন চলবে। দেশ থেকে যেই হারে শ্রমিক পাঠানো হয়েছে, সেই হারে বাড়ছে না প্রবাসী আয়। এতে ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। যদিও অর্থবছরের শেষ মাসে এসে প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে কোরবানির ঈদ বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থবছরের শেষে রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। বিশ্বমন্দার আশঙ্কার মধ্যে এই প্রবৃদ্ধিও আগামী দিনে অব্যাহত থাকবে কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে আগামীতে আইসিটি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
রেকর্ড ডলার বিক্রি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার সংকট থাকার কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। তাই মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড সাড়ে ১৩ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে জ্বালানি তেল, সারসহ অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার জন্য ব্যাংকগুলোকে শুধু ডলার দেওয়া হচ্ছে। রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভের পরিমাণও কমছে। তবে এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর সস্তায় ডলার কিনতে পারবে না ব্যাংকগুলোও।
গতকাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকও ১০৮ টাকা ৭৫ পয়সা দরে অর্থাৎ আন্তঃব্যাংক দরেই ৭ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। ডলার বিক্রি করলেও রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়ায় রিজার্ভের পরিমাণও বাড়ছে।
গতকাল রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও দেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে বাজারে ডলারের কোনো সংকট নেই। বাজারে পণ্যসামগ্রীরও কোনো ঘাটতি নেই।
এই প্রসঙ্গে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র জিএম তাসলিম শাহরিয়ার কালবেলাকে বলেন, ডলার সংকট কাটা তো দূরের কথা এখন আরও বেড়েছে। পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে আমরা যে চাহিদা দিচ্ছি ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে সব এলসি খুলতে চায় না। এ ছাড়া এখন প্রতিটি এলসির জন্য এলসি মার্জিন রাখতে হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে ডলারের স্বাভাবিক অবস্থায়ও কোনো ব্যাংকের কাছে বেশি ডলার থাকে আবার কোনো ব্যাংকের কাছে কম থাকতে পারে।
তিনি বলেন, এলসি মার্জিন তো ব্যাংকের স্বার্থে রাখা উচিত। কেন না আমদানিকারক যদি তার আমদানি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিচ্ছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রয়োজনীয় খরচও কমানো হচ্ছে।
বর্তমানে প্রতি ডলার কিনতে আমদানিকারকদের ব্যাংকগুলোকে ১০৬ থেকে ১০৯ টাকা দিতে হচ্ছে। এই বাড়তি দাম দিয়েও ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্য, সার, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার সরবরাহ করেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারছে না। অন্যদিকে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
ইডিএফ ফান্ডের আকার কমিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনে চলতি মাস থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ দ্রুত সমন্বয়ের মাধ্যমে এর আকার কমিয়ে আনছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরই মধ্যে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে ইডিএফের আকার ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে। এমনকি চলতি অর্থবছরে বাজারে রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রির পরও রিজার্ভ পরিস্থিতির খুব একটা অবনতি হয়নি। গত মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধের পর থেকে রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই অবস্থান করছে।
রপ্তানি শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে ১৯৮৯ সালে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়। মাত্র ১ কোটি ৫০ ডলার নিয়ে গঠিত এ তহবিলের আকার রিজার্ভ থেকে অর্থের জোগান দিতে দিতে ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইডিএফসহ অন্য ঋণ তহবিলগুলোতে জোগান দেওয়া অর্থ রিজার্ভ থেকে আলাদা করে দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে আইএমএফের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরকালে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত নিয়ে আলোচনাকালে বাংলাদেশকে এমন পরামর্শ দিয়েছিল। রিজার্ভের হিসাব আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতেই এমন পরামর্শ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে চলতি মাসের মধ্যে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেইসঙ্গে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। সে অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে রিজার্ভের অর্থে গঠিত তহবিলগুলো আলাদা করে দেখানো এবং এগুলো পর্যায়ক্রমে গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরই মধ্যে রিজার্ভের অর্থে গঠিত গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড থেকে পুনঃঅর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর ইডিএফের আকার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ কারণে এ তহবিল থেকে অর্থায়নে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে এ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর এখন নিতে পারবেন সর্বোচ্চ ২ কোটি ডলার। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ইডিএফ থেকে নতুন ঋণ বিতরণের চেয়ে আগের ঋণ আদায়ে বেশি জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য গত ১৯ মার্চ একটি সার্কুলার জারি করে বলা হয়েছে, এ তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করলে ব্যাংকগুলোকে ৪ শতাংশ হারে ‘পেনাল ইন্টারেস্ট’ দিতে হবে।
এ ছাড়া ইডিএফ ঋণের চাপ কমাতে গত জানুয়ারি মাসে রপ্তানি সহায়ক ১০ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিলের ঋণ নিরুৎসাহিত করতে কয়েক মাস ধরে কয়েক দফা সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে সুদের হার বাড়িয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা বলেন, ইডিএফ ফান্ডের আকার কমানো হলেও তাদের কোনো সমস্যা হবে না। কেননা রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে বৈদেশিক মুদ্রার ফান্ড আগেই গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশীয় মুদ্রায়ও তাদের জন্য একটি ফান্ড গঠন করা হয়েছে। ফলে তারা দুদিক থেকেই সুবিধা পাবে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেনাও শুরু করেছে। সম্প্রতি দুটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ছিল এ অর্থবছরে বেসরকারি খাত থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেনা প্রথম ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, অর্থবছরের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো দেখাতে ব্যাংক থেকে ডলার কেনা শুরু করেছে।
মন্তব্য করুন