প্রায় আট বছরেও কাউন্সিল হয়নি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির। অথচ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলন (কাউন্সিল) করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। এ সময়ের মধ্যে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারবিরোধী একটি আন্দোলনও করেছে দলটি। তবে নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিল করতে না পারার জন্য সরকারের দমন-পীড়নকে দায়ী করছে বিএনপি। অবশ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের অভ্যন্তরে এখনো জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে বিস্তর আলোচনা নেই। তবে চলতি বছরের শেষ নাগাদ তাদের পরিকল্পনায় কাউন্সিল রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল।
বিএনপির আন্দোলন ও বর্জনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন কাউন্সিলের চেয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদ পূরণে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি শূন্যপদ পূরণও করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিগত আন্দোলনে ব্যর্থতায় সারা দেশে সংগঠন পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। জেলা ও মহানগরে সংগঠন গুছিয়ে তারপর দলের সপ্তম কাউন্সিলের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। আসন্ন রমজান থেকে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, এই সরকার একটা সর্বগ্রাসী সরকার। তারা বাংলাদেশে বিরোধী দলকেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। আমরা যখনই দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় কোনো কর্মকাণ্ড করতে গিয়েছি, সারা দেশে আমরা যখন জেলা কাউন্সিলগুলো করতে গিয়েছি, আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ যোগসাজশে সেখানে গিয়ে বাধা সৃষ্টি করেছে, মঞ্চ ভেঙে দিয়েছে। আর আমরা যখন আমাদের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করতে গিয়েছি, কাউন্সিলের আগের রাত ১২টা পর্যন্ত কাউন্সিল স্থল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন তারা দখল করে রেখেছিল। অর্থাৎ সরকার এলে নিজেরাই চায় না যে, এখানে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠুক। সেই উদ্দেশ্যে তারা বিরোধী দল, বিরোধী দলের সংগঠনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য সাংগঠনিক প্রক্রিয়াগুলোকে সম্পূর্ণ বাধাগ্রস্ত করেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা নিজেরা যতদূর সম্ভব আমাদের দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি। কাউন্সিল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা চলতেই থাকবে।
বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের প্রায় পাঁচ মাস পর ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট স্থায়ী কমিটির ১৭ সদস্যসহ ৫০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। এর পাশাপাশি ঘোষণা করা হয় ৭৩ সদস্যের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের নামও। এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা মারা গেছেন। কেউ কেউ পদপদবি থেকে বাদ পড়েছেন। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ এখন শূন্য। এ ছাড়া বয়সজনিত কারণেও কয়েকজন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়।
এদিকে ষষ্ঠ কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া পুনরায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে গেলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। পরে নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। তবে মুক্তি পেলেও দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় বেগম জিয়া রাজনীতির মাঠের বাইরে রয়েছেন। দল পরিচালনায় কোনো বিষয়ে সাধারণত তিনি সিদ্ধান্ত দেন না।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির মধ্যে ৩১টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। বাকি ৫১টি রয়েছে আহ্বায়ক কমিটি। এর মধ্যে মাত্র ১০টিতে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন নিয়ে বিএনপির মূল্যায়ন, দলের ২০ থেকে ২৫ সাংগঠনিক জেলার নেতারা আন্দোলনে ছিলেন না। দলকে শক্তিশালী করতে ওইসব জেলা ও মহানগর কমিটি ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে, সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হোক কিংবা না হোক। ওই জেলাগুলোতে যেসব নেতাকর্মী আন্দোলনে ছিলেন, তাদের ওই সব কমিটিতে পদায়ন করা হবে। সরাসরি কেন্দ্র থেকে সেখানে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পদ রয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে শুরু থেকেই দুটি পদ শূন্য। পরবর্তীতে এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেলে ছয়টি পদ শূন্য হয়। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করায় শূন্যপদ সাতে দাঁড়ায়। পরে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে নিয়োগ দেওয়ায় এখন পাঁচটি পদ খালি রয়েছে স্থায়ী কমিটিতে। তবে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণের জন্য দলের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এর আগেও দলে একাধিকবার স্থায়ী কমিটি পুনর্বিন্যাস করার আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে তখন দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের কমিটিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।