রাজধানীর মানিকনগর খালপাড়ে রুহাব মিয়ার চায়ের দোকান। বাসাও এর পাশেই। এই এলাকায় মশার উপদ্রব এত বেশি যে, দিনের বেলায় দোকানে কয়েল জ্বালিয়েও রক্ষা পাচ্ছেন না তিনি। রুহাব মিয়া জানান, ‘সারাদিনই মশা, সন্ধ্যার পর আরও বাড়ে। একটি কয়েলের দাম পাঁচ টাকা, দিনে দুটি কয়েল দিলে ১০ টাকা যায়। মাসে লাগে ৩০০ টাকা। এই টাকা পাব কোথায়?’
শুধু মানিকনগরের রুহাব মিয়াই নন, রাজধানীজুড়েই মশার তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মানুষ। ছোট্ট এই প্রাণীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুই সিটি করপোরেশন যেন ‘নিধিরাম সর্দার’। প্রতি বছর বাড়ছে মশা মারার বাজেট। গতানুগতিক পদ্ধতিতে চলছে ‘লোক দেখানো’ নানা আয়োজন। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। দুই সিটির আনুষ্ঠানিকতার বহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে মশার উপদ্রব।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে আলাদা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটির মশা মারার বাজেট ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মশার ওষুধ কেনায় ৪৫ কোটি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনায় ৩০ কোটি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায় ৩০ কোটি, ফগার মেশিনসহ যন্ত্রপাতি পরিবহনে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়া আগাছা পরিষ্কারে ১ কোটি ৫০ লাখ, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বিশেষ কর্মসূচিতে ১ কোটি, মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযান পরিচালনায় ২ কোটি এবং ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এ খাতে দক্ষিণ সিটির বাজেট ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কেনা হবে। বাকি ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা ও পরিবহন খাতে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে দক্ষিণ সিটি এবার বরাদ্দ রেখেছে ৩০ কোটি টাকা।
মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ড্রোন, রোড শো, পরিচ্ছন্নতা ও মশককর্মীদের শরীরে অত্যাধুনিক বডি ক্যামেরা সংযোজন করেছে। নানা সময়ে কাজে ব্যবহার করা হয়েছে হাঁস, পাখি, গাছ ও মাছ। তবে মশা বাগে আসেনি। উল্টো প্রতি বাজেটেই যুক্ত হয় বাড়তি খরচ। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হওয়ার পর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দুই সিটিতে মশা মারতে প্রায় ১২শ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটির খরচ হয়েছে ৫০০ কোটি এবং ঢাকা উত্তরের খরচ হয়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এ টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশকসহ আরও অনেক কাজে ব্যয় হয়। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডে মশা নিধনে ১৫০ জন মশক সুপারভাইজারসহ ১ হাজার ৫০ জনবল কাজ করছেন। উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডে ৭৫ জন মশক সুপারভাইজারসহ প্রায় ৬০০ জনবল আছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এত কিছুর পরও মশা নিধনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি করপোরেশন। ফলে মশার যন্ত্রণার পাশাপাশি নগরবাসী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। গত বছর মশাবাহিত এ রোগে ভুগেছেন ঢাকার ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে মারা যান ৯৮০ জন।
সাধারণত জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। কিন্তু গত বছরের এডিসের প্রজননস্থলের পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান গবেষকরা। সে সময় কংক্রিটের দেয়ালের ফাঁকেও এডিস জন্মানোর প্রমাণ মিলেছে। সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম ধরা হলেও এখন সারা বছরই দেশে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এডিস মশার জীবনচক্র অনুযায়ী মে মাসের পর থেকে ডিমগুলো লার্ভায় পরিণত হতে থাকে। জুন, জুলাই ও সেপ্টেম্বর হচ্ছে এডিসের ভরা মৌসুম। কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এবার বর্ষার মৌসুমে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের চেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
নগরবাসীর অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের গাফিলতি, কার্যকরী ওষুধ ব্যবহার না করা, ঠিকমতো ওষুধ না ছিটানো ও প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে না পারায় মশার উপদ্রব কমে না। হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সবসময় ছিটানো হয় না মশার ওষুধ। সিটি করপোরেশন থেকে যেখানে নিয়ম আছে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে মশার ওষুধ ছিটাতে হবে, সেখানে তাদের অভিযোগ কালেভদ্রে এই ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। আর সামনেই ডেঙ্গুর মৌসুম হওয়ায় আতঙ্ক বাড়ছে।
উত্তরা সেক্টর কল্যাণ সমিতিকে প্রতি মাসেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ বাড়িওয়ালাদের ৩ হাজার টাকা গুনতে হয়। তবু ঠিকঠাক পরিষ্কার হয় না ময়লা, যা নিয়ে ক্ষোভ এলাকাবাসীর।
শরিফুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘দিনে-রাতে অনেক মশা, কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের এখানে কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। আমরা মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।’
ধোলাইরপাড়, দনিয়া, যাত্রাবাড়ী এলাকায় ড্রেনের আশপাশের বাসাবাড়িতে মশার উৎপাত অনেক বেশি। আজিমপুরে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়। স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী যে যার মতো ময়লা ফেলছেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জঞ্জাল অপসারণ করেও হিমশিম খাচ্ছেন।
ময়লা আবর্জনায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে এখন মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকার ঝিল।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বর্ষার আগেই রাজধানীর বেশকিছু খাল পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিরপুর এলাকায় নেই কোনো উদ্যোগ। এতে আতঙ্ক বাড়ছে সেখানকার বাসিন্দাদের। কালশী এলাকার খালটি ছোট হতে হতে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর কোনো ধরনের পরিষ্কারের উদ্যোগ না থাকায় বেড়েছে কচুরিপানা ও নানা ঝোপঝাড়। তাই বিকেল থেকেই বাড়তে থাকে মশার উপদ্রব। মিরপুরের রূপনগর ও আরামবাগ ঘুরে এ রকম আরও কয়েকটি খাল পাওয়া গেছে, যেগুলোতে ময়লা আবর্জনার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মশার প্রজনন।
কীটতত্ত্ববিদ ড. ইন্দ্রানি ধর বলেন, ‘এবার মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে গত বছরের ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে লার্ভিসাইডিং আর ফগিং করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন করে একটি সার্ভে করতে হবে। যে ওয়ার্ডগুলোতে মশার সংখ্যা বেশি আর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকাল ক্যাম্প স্থাপন করে সকাল-বিকেল লার্ভিসাইডিং ও ফগিং করতে হবে।’
মশা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশন অবৈজ্ঞানিক বা ভুল পদ্ধতিতে মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের সঠিক পরামর্শ দিলেও কখনো পরামর্শমতো কাজ করেনি। মশা মারার টাকা সব ড্রেনে গেছে। প্রতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত রাজধানীর একেকটি এলাকায় ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য (ক্লাস্টার) তৈরি হয়। এই ক্লাস্টারগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের এ অর্থ অপচয় করেছে সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজরা লুটপাটও করেছে।’
মশা নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কীটতত্ত্ববিদরা। শহরের কোথায় মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়েছে এবং সেখানে মশা নিধনে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার, তা নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেন করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদরা। তার ওপর ভিত্তি করেই করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থাকলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এ রকম কেউ নেই। ফলে মশার প্রজননক্ষেত্র বা উৎপত্তিস্থল অজানা থেকে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে উত্তর সিটি ব্যবহার করে ম্যালাথিয়ন, টেমিফস, নোভালুরন নামক কীটনাশক। আর দক্ষিণ সিটিতে ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন কীটনাশক ব্যবহার হয়। গত বছর মশা নিধনে নতুন অস্ত্র বিটিআই আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় ডিএনসিসি। জৈবিক লার্ভা ধ্বংসকারী এই ওষুধ ব্যবহারে সুফল মিলেছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এ দেশে আমদানির আগেই ধরা পড়ে নানা অনিয়ম। এতে মশা মারার শেষ আশাও মুখ থুবড়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারও বিটিআই আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নাগাদ আসছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কার্যকর এই কীটনাশকটি আনা সম্ভব হবে বলে আশা তাদের।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির কালবেলাকে বলেন, ‘মশার উপদ্রব বেশি যেসব এলাকায়, সেখানকার জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে বৈঠক করা হচ্ছে। আগামী ২১ মে ঢাকার সব সংস্থাকে নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জুন মাস থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত শুরু করা হবে।’
তিনি জানান, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদ নেই, তবে মশক নিয়ন্ত্রণে কারিগরি কমিটি রয়েছে। সেখানে কীটতত্ত্ববিদরা আছেন। সিটি করপোরেশন তাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে।’
এদিকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি, নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের জ্ঞানের অভাব ও অসহযোগিতা, পরিত্যক্ত অপরিকল্পিত ছাদবাগান, বেজমেন্ট পার্কিংয়ে জমা হওয়া পানি এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সংখ্যার তথ্যে অপ্রতুলতা। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় গত ২২ এপ্রিল থেকে মাসব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এ সিটি করপোরেশন।
কোনো বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলে জেল-জরিমানার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সবাই সচেতন না হলে সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে, লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করছে। জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এডিসের লার্ভা পেলে ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করছেন। রোদ ও বৃষ্টি—এমন আবহাওয়ায় জমা পানিতে এডিসের লার্ভা জন্মায়। তাই এই সময়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’