ব্যবসায়িক তথ্য গোপন করে দুই বছরে সরকারের ১৩৯ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এ সময় কোম্পানিটি পণ্য বিক্রির প্রকৃত তথ্যের চেয়ে ৮২৯ কোটি টাকা কম দেখিয়েছে। সেইসঙ্গে এ প্রতিষ্ঠান নিয়মবহির্ভূতভাবে ৪২ লাখ টাকার রেয়াতি সুবিধা গ্রহণ করেছে। ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, দেশের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছে নাভানা ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেড। বাজারে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি বাড়লেও দীর্ঘদিন ভ্যাট পরিশোধের পরিমাণ বাড়েনি। বিষয়টি নজরে আসার পর নিরীক্ষার (অডিট) সিদ্ধান্ত নেয় এলটিইউ, ভ্যাট। পরে এ বিষয়ে নিরীক্ষা কমিটিও গঠন করে ভ্যাট আহরণকারী এ প্রতিষ্ঠান। নিরীক্ষায় কোম্পানির নানা ধরনের অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১-এর জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৬০ কোটি ১১ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৩ টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা রিটার্নে বিক্রি দেখানো হয়েছে ১ হাজার ১৩০ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ টাকা। অর্থাৎ দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি কম দেখিয়েছে ৮২৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ১৬৪ টাকা। মূলত ভ্যাট ফাঁকি দিতেই এ তথ্য গোপন করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী হিসাব করলে রিটার্নে গোপন করা বিক্রি থেকে সরকার ভ্যাট পাবে ১২৪ কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৪ টাকা।
নাভানা ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেড ২০২২ সালে দেশের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১০৭ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড শুধু পণ্য বিক্রির তথ্য গোপন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি বেআইনিভাবে রেয়াতও নিয়েছে। ২০২১-এর জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন উপকরণের বিপরীতে মোট ৪২ লাখ ২৮ হাজার ৪১৬ টাকা অবৈধ রেয়াত নিয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৬৭ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৭৬ হাজার ৭৭৩ টাকা।
জানা গেছে, সেবামূল্য হিসেবে পরিশোধ দেখিয়ে এ রেয়াত নেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠান তা করেনি। এ কারণে এ রেয়াত অবৈধ হিসেবে বাতিল করে অর্থ আদায়ের পক্ষে মত দিয়েছে নিরীক্ষা কমিটি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি উৎসে ভ্যাটেও ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎসে ভ্যাট বাবদ ফাঁকি দিয়েছে ৬ কোটি ৯৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৬ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফাঁকি দিয়েছে ১০ কোটি ২৪ লাখ ১১ হাজার ৪৭৩ টাকা। অর্থাৎ দুই অর্থবছরে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড উৎসে ভ্যাট বাবদ ফাঁকি দিয়েছে ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৩২০ টাকা।
জানা গেছে, এই ফাঁকি ধরা পড়ার পর শুনানি ডাকা হলে কোম্পানিটি ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫১৪ টাকা পরিশোধের প্রমাণ দিয়েছে। ফলে উৎসে ভ্যাট বাবদ প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩ হাজার ৮০৬ টাকা। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৩৯ কোটি ৪৫ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৭ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কাছে সরকারের পাওনা এ অর্থ আদায়যোগ্য বলে মত দিয়েছে নিরীক্ষা কমিটি। সেজন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট আইনের ১২৭ (১) অনুযায়ী সময়মতো ভ্যাট পরিশোধ না করার জন্য সুদ আদায়ের সুপারিশও করেছে এলটিইউ ভ্যাটের নিরীক্ষা কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলটিইউ ভ্যাটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বিক্রির তথ্য থেকে রিটার্ন দাখিলে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া গেছে। মূলত ভ্যাট ফাঁকি দিতে বিক্রি কম দেখানো হয়েছে। উৎসে ভ্যাট পরিশোধেও গড়িমসি করেছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে রেয়াতও নিয়েছে।’
বিষয়গুলো নিয়ে এরই মধ্যে নাভানা ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেডের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বলেও এলটিইউ ভ্যাটের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. জুনাইদ শফিক কালবেলাকে বলেন, ‘ভ্যাট ফাঁকির এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এনবিআর অতিরিক্ত ভ্যাট দাবি করতেই পারে। তবে তাদের সেই দাবি বাস্তবসম্মত নয়।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য তিনি কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে সিএফও আবু হুরায়রা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সঠিকভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করেই ব্যবসা করি। কিন্তু ভ্যাট কর্মকর্তারা কোম্পানির টিএ-ডিএর ওপরও ভ্যাট হিসাব করেছেন। এ ছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রেও আমাদের হিসাব আমলে নেননি তারা।’
সব মিলিয়ে এনবিআর ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার বেশি ভ্যাট পাবে না বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
তিনি জানান, এলটিইউ ভ্যাট তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে যে চিঠি দিয়েছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে আগামী সপ্তাহে তার জবাব দেওয়া হবে।