প্রতি বছরই দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটের আকারসহ নির্ধারিত বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা তার আগের বাজেটের সব লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হোক বা না হোক কিংবা বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাব জেনেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত বারবার এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণের পথে হাঁটত সরকার। গত এক দশকের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় এমন ধারাবাহিকতাই দেখা গেছে। তবে এবারই এই ধারার ব্যতিক্রম ঘটতে চলেছে। আসন্ন বাজেটের বেশিরভাগ সূচকের লক্ষ্যেই প্রথমবারের মতো থাকছে না উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ছাপ। বরং বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার, ঘাটতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, জাতীয় বিনিয়োগ, সঞ্চয়, সরকারি পরিচালন ব্যয় এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রাক্কলনে বেশ সংযত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আগামী বাজেটটি কোনোভাবেই উচ্চাভিলাষী হবে না। বরং এই বাজেট হবে বাস্তবতার নিরিখে অনেকটা সংকোচনমুখী। এর মানে হচ্ছে, বাজেটের আকার ছোট হবে। সেটি চলতি অর্থবছরের তুলনায় বড়জোর ৫ শতাংশ বাড়বে, যা আগে ৮ থেকে ১০ শতাংশ বা তারও বেশি হতো। শুধু বাজেটের আকারই নয়, বরং অর্থনীতির মানদণ্ড নির্ধারক বাজেটের সব সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রেই থাকবে সংযত পদক্ষেপ। যতটা সম্ভব চেষ্টা থাকবে
শতভাগ বা তার অনেকটাই কাছাকাছি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়নের। সেভাবেই আমরা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট চূড়ান্ত করতে যাচ্ছি।
বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই বাজেটের সব পদক্ষেপই হওয়া উচিত সংকটমোচনকে কেন্দ্র করে। এজন্য যতটা সম্ভব ব্যয় সংকোচনমুখী বাজেট তৈরিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেখানে অর্থ বিভাগের পরিকল্পনা যদি প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে রূপান্তর ঘটে, তা হলে সময়োপযোগী বাজেটই হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সরকার প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে যাচ্ছে। এই বাজেটে সরকারের যে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় রয়েছে, তার সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ব্যয় বাড়িয়ে মানুষের সক্ষমতা উন্নয়ন, নগদ ভর্তুকি ও প্রণোদনা এবং ঋণ বাড়িয়ে মোট দেশজ উৎপাদনকে ত্বরান্বিতকরণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার: সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে (এমটিএমএফ) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ধরা আছে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। কিন্তু দেশে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে থাকায় সামগ্রিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমেছে। নতুন বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কম হয়েছে। অন্যদিকে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে ভোগ কমে গেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সরকার আসন্ন অর্থবছরের জন্য সংযত ও সতর্ক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। এতে নতুন লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকায় সেটি ওই বছর সংশোধিত বাজেটে নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের অর্জিত প্রবৃদ্ধি থেকে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ কম ছিল। তা সত্ত্বেও সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতার নানা সীমাবদ্ধতা জেনেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারের উচ্চাভিলাষী স্তরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধির হারকেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে আনতে হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির হার: সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর (এমটিএমএফ) লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরতে হতো ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সরকার বাস্তবতা বুঝে সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই দূরে সরে আসছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, যা প্রাক্কলিত এমটিএমএ এর লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবতা আমলে নিয়ে ওই বছরের সংশোধিত বাজেটে সেটি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। যদিও তখন গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ অঙ্কের ঘরে। কিন্তু পরের বছরই সেটি ভুলে গিয়ে নতুন বাজেটের জন্য ফের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রার পথে হাঁটে সরকার। যে কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, বছরের গড় মূল্যস্ফীতি এ সময় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশের মধ্যেই আটকে থেকেছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হয়েছে। এই বাস্তবতায় সংগত কারণেই আগে যেখানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে যতটা সম্ভব কমিয়ে ধরার চেষ্টা হতো, এবার সেটি সরকার নিজেই বাড়াতে যাচ্ছে।
বিনিয়োগ জিডিপি: ২০২২-২৩ অর্থবছর বিনিয়োগ জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও সেটির লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ফের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনতে হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশে। তা সত্ত্বেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অস্বাভাবিক বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঢালি সাজিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে তিনি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিনিয়োগ আনার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাবও ধোপে টেকেনি। ফের সংশোধনের মাধ্যমে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে। এই বাস্তবতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের বিনিয়োগ বা বিনিয়োগ জিডিপি মাত্র ০.৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। এটি সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর (এমটিএমএফ) প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ কম।
বাজেট ঘাটতি: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির আকার জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখতে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বেশ সতর্ক ও সংযতভাবে হিসাবনিকাশ কষছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছর যেখানে বাজেট ঘাটতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়, সেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমিয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আসন্ন অর্থবছর সরকার ঘাটতির আকারকে জিডিপির ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায়। সেভাবেই নতুন বাজেট তৈরি করতে যাচ্ছে অর্থ বিভাগ।