ঈদযাত্রায় নৌ, সড়ক, রেলসহ আকাশপথে রীতিমতো ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে। তবে ঘরে ফেরার টিকিটের জন্য হাহাকার অবস্থা। ‘সোনার হরিণ’ টিকিটের আশায় নামিদামি বাস কোম্পানির কাউন্টারগুলোয় ঘুরছেন লোকজন। কমলাপুরে রেলস্টেশনেও দেখা গেছে টিকিটপ্রত্যাশী মানুষের ভিড়। যদিও অগ্রিম টিকিট বিক্রি কার্যক্রম অনেক আগেই শেষ করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবুও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিআইপি তদবির দেখা গেছে স্টেশনের ম্যানেজার ও মাস্টারের কক্ষে। তদবিরের যন্ত্রণায় স্টেশনের অনেক কর্মকর্তাকে নিজের রুম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে অফিস করতেও দেখা গেছে।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেষ কর্মদিবস। আজ শুক্রবার থেকে টানা পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি শুরু হচ্ছে। সাপ্তাহিক ও ঈদের ছুটি মিলিয়ে ১৮ জুন পর্যন্ত ছুটি পাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে ১৯ ও ২০ জুন ছুটি নিলেই ১৪-২২ জুন পর্যন্ত টানা নয় দিন ছুটি পাবেন সরকারি কর্মকর্তারা। তাই শেষ কর্মদিবসে দুপুরের পর থেকেই ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে সড়ক, রেলপথ ও নৌ টার্মিনালে। এ কারণে যানজটের ভোগান্তি হয়েছে নগরীতে।
সকাল থেকে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে দেখা গেছে মানুষের চাপ। রেলপথে ঈদযাত্রা শুরুর দিন গত বুধবার বেশিরভাগ ট্রেন বিলম্বে ছাড়লেও দ্বিতীয় দিনে এরকম অভিযোগ ছিল না যাত্রীদের। সর্বোচ্চ ১৫ থেকে আধাঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে অনেক ট্রেন। তবে বেশিরভাগ ট্রেন সময়মতো ছাড়ার দাবি রেল কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি দুপুরের মধ্যেই দুটি ক্যাটল ট্রেন এসে কমলাপুরে পৌঁছায়।
ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার কালবেলাকে বলেন, বৃহস্পতিবার ৬৯ জোড়া ট্রেন কমলাপুর থেকে আসা-যাওয়া করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ট্রেন সময়মতো ছেড়েছে। তিনি বলেন, এবারের ঈদযাত্রায় পশুবাহী ট্রেন, আমের ট্রেন, নিয়মিত পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে। একবারে বিভিন্ন ধরনের ট্রেন পরিচালনা এর আগে করতে হয়নি। এজন্য কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
নৌপথে যাত্রী বাড়লেও আগের মতো চাপ বাড়েনি। তবে আজ থেকে যাত্রীর চাপ বাড়ার কথা জানিয়েছেন, সদরঘাটে দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিএ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মুনিরুল ইসলাম।
সড়কপথে অনলাইনে নামিদামি বাস কোম্পানির টিকিট বিক্রি অনেক আগেই শেষ। তবুও চেষ্টার খামতি নেই কারও। সোনার হরিণ টিকিট পেতে কাউন্টারে কাউন্টারে ভিড় করছেন যাত্রীরা। তবে ছোটখাটো বাস কোম্পানিগুলোতে সহজেই বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছেন নগরবাসী। গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে দুপুরের পর থেকে ভিড় বাড়ে। গ্রিনলাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ রুটে বাসের টিকিট নেই। তবে চাহিদা এখন অনেক বেশি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ কালবেলাকে বলেন, এবার সড়কের পরিস্থিতি ভালো। মহাসড়কের পাশে বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে আশা করি কোনো দুর্ভোগ হবে না।
রেলপথে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে গতকাল রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় রেল সচিব, রেলওয়ে মহাপরিচালকসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, গতবারের মতো এবারও ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পাবেন।
কালোবাজারে টিকিট বন্ধে রেলওয়ে পুলিশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। কমলাপুরে রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন রেল, সড়ক ও নৌপথে নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পুলিশ কাজ করছে। কালোবাজারে টিকিট বন্ধ করতে রেলওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
উত্তরের পথে বাড়ছে গাড়ির চাপ, প্রস্তুত হাজারো পুলিশ: সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। ফলে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কসহ উত্তরের সব রুটেই ক্রমশ যানবাহনের চাপ বাড়ছে। এদিকে উত্তরের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রস্তুত রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা ও হাইওয়ে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়ক ও হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় দেখা যায়, ধীরে ধীরে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। তবে কোথাও যানজট বা ধীরগতি নেই। মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে আগেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে সাসেক-২ প্রকল্পের আওতায় এলেঙ্গা- রংপুর ৪ লেনে উন্নীতকরণ কাজের সব হাইওয়ে ওভারপাস খুলে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে মহাসড়কে নির্বিঘ্নে চলছে গাড়ি।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। তবে যানজট বা ধীরগতি নেই।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল ওদুদ বলেন, এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে জেলা পুলিশের পাশাপাশি ২০০ হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে দায়িত্বে রয়েছে।
উত্তরের পথে দিনভর যানবাহনের চাপ: টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, ঈদযাত্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল ও বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু সেতুতে বেড়েছে টোল আদায়ের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় সেতুতে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল জানান, ঈদ সামনে রেখে যানবাহনের পারাপার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেতু পারাপারে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সে লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যানজট নিরসনে সেতুর উভয় অংশে ৯টি করে ১৮টি টোল বুথ স্থাপনসহ মোটরসাইকেলের জন্য চারটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে।
চাপ বেড়েছে গাজীপুরের দুই মহাসড়কে: কালবেলা প্রতিবেদক, গাজীপুর জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের চন্দ্রায় ও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তায় যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া বিকেলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা বাড়িয়েছে। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানজট নিরসন ও যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে গাজীপুর মহানগর, জেলা ও হাইওয়ে পুলিশ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
পুলিশ, যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় হয়ে উত্তরবঙ্গে ২২ জেলার প্রায় ১১৭টি রুটের যানবাহন চলাচল করে। ভোগড়া থেকে টঙ্গীর কলেজগেট পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের মাঝের লেন দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখায় দুই পাশের যানবাহনে স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
নাওজোড় হাইওয়ে থানার ওসি শাহাদাত হোসেন বলেন, মহাসড়কে যানবাহনের চাপ অনেকটা বেড়েছে। এ জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) আলমগীর হোসেন বলেন, যানজট নিরসনে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ৫০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। বিআরটি প্রকল্পের মাঝের লেন ময়মনসিংহগামী যানবাহনের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এ ছাড়া চান্দনা চৌরাস্তা ও ভোগড়া বাইপাস এলাকায় আমাদের আলাদা নজরদারি থাকবে।
গাজীপুরে পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৪০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ফাঁকা, নির্বিঘ্নে আসছে পশুবাহী যান: কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ১১০ কিলোমিটার অংশে ঈদযাত্রা কেন্দ্র করে যানবাহন বাড়লেও মহাসড়ক ফাঁকা রয়েছে। যানবাহনের তেমন চাপও নেই। তবে ট্রাকে ট্রাকে কোরবানির পশু আসছে। পশুবাহী ট্রাকের চালক ও ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো মহাসড়কে যাত্রা স্বস্তিদায়ক। তারা এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার চাঁদাবাজির মুখে পড়েননি।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মহাসড়কের দাউদকান্দি, চৌদ্দগ্রাম, পদুয়ার বাজার, বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন অংশ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে দাউদকান্দি টোলপ্লাজায় দুপুর ১২টার দিকে কিছু যানজট দেখা যায়।
কুমিল্লা রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঈদ উপলক্ষে হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নে ৪৪টি মোবাইল টিম, ৩৪টি পিকেট টিম, ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের ২২ থানায় ২২টি কুইক রেসপন্স টিম, ইন্টেলিজেন্স টিম কাজ করছে।
রূপগঞ্জে ২০ কিমিজুড়ে যানজট, ভোগান্তি চরমে: রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান বাইপাস সড়কে দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রী ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থেমে থেমে চলে গাড়ি। আবার কোথাও থেমে থাকে ঘণ্টা ধরে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থেমে থেমে এ দুই সড়কে যানজটের সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দেশের অন্যতম ব্যস্ত সড়ক ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে শুরু করে বরপা এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে ও মদনপুর-গাজীপুর এশিয়ান বাইপাস সড়কে ৮ কিলোমিটার সড়কজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে এ সড়কে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনের চালক ও যাত্রী সাধারণ চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট ও এশিয়ান বাইপাস প্রধান সড়কে প্রায় ১২ স্পটে এবারের ঈদে ভোগান্তির শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।