ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার পাঁচ জনের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে একজনের। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিবর্তনের আশায় তিনি এ পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিলেন। এমপি আনারকে হত্যার মূল কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া দেশে ফিরে এলে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে এমপি হত্যার ছবি আদান-প্রদান করেছেন তারা।
আদালত ও মামলার তদন্ত সূত্র বাবুর এই জবানবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গতকাল শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালতে বাবুর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত ৯ জুন আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড চলাকালে আসামি বাবু স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন।
এর আগে আদালতে নিজেদের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ, তার ভাগ্নে তানভীর ভূঁইয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আক্তারুজ্জামানের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে ১৩ মে এমপি আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা ও লাশ গুমের পর ১৫ মে দেশে ফিরে আসেন শিমুল ভূঁইয়া। যিনি এমপিকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। শিমুল দেশে ফিরে আসার পর দিন ১৬ মে রাতে বাবুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন। তারা ১৭ মে ফরিদপুরের ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিমুলের গাড়িতে গোপন বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে হত্যার ছবি, টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়ে আলাপ হয়। আনার হত্যা-পরবর্তী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাবুর কাছে শিমুল টাকা দাবি করেন। দাবি করা এ টাকার একটি অংশ ২৩ মে পরিশোধের আশ্বাস দেন বাবু। টাকা নেওয়ার আগেই দুই সহযোগীসহ ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হন শিমুল ভূঁইয়া। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় এই বিষয়গুলো জানিয়েছিলেন বাবু। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও একই বিষয়গুলো স্বীকার করেন তিনি।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু ওই জেলার সাধারণ সম্পাদক ও এমপি মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইদুল করিম মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহচর। শোকাহত আনার পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতেও মিন্টু ও বাবু একসঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। মিন্টুর হয়ে কিলার শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ ও লেনদেনের বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
এমপি আনারকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে মিন্টুর সঙ্গে আক্তারুজ্জামান শাহীনের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছিল তার। যে কথোপকথনে আনারকে হত্যার পরিকল্পনার আভাস পেয়েছিলেন মিন্টু। পরে এ-সংক্রান্ত আলোচনার জন্য মিন্টুর পক্ষ থেকে বাবুকে এবং শাহীনের পক্ষ থেকে শিমুলকে মনোনীত করা হয় বলে জানিয়েছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, আক্তারুজ্জামান শাহীনের হয়ে লিয়াজোঁ করেছেন শিমুল ভূঁইয়া ও মিন্টুর হয়ে বাবু। বাবু জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, মূল যে ঘাতক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে একাধিক মিটিং করেছেন তিনি। ফোনে কথা হয়েছে, ভাঙ্গায় বসে শলাপরামর্শ হয়েছে। একটি পর্যায়ে মৃত ব্যক্তির ছবি দিয়েছে মিন্টুকে।
এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। তার গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মামলা হওয়ার আগে বা শাস্তি হওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী কাউকে অপরাধী বলা যায় না; কিন্তু ওই সৎ সাহস আওয়ামী লীগের আছে যে, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু আজকে রিমান্ডে। এমন উদারহণ এরশাদ বা বিএনপি আমলে এ দেশে ছিল না।
গত ৫ জুন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শিমুল ভূঁইয়া জানিয়েছেন, হত্যার এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের আরেকজন নেতার (মিন্টু) সঙ্গে তারা টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন। হত্যার মিশন সফল হলে ওই নেতা দুই কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এমপি আনারকে হত্যার পর আসামিরা বাংলাদেশে ফিরে এলে প্রথমে ২০ লাখ আর ২৬-২৯ মে তারিখের দিকে দেবে বাকি ১ কোটি ৮০ লাখ।
আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে শাহীনকে শনাক্ত করেছেন ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা। যিনি বর্তমানে আমেরিকা রয়েছেন। আর অর্থদাতা হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুকে। ৮ দিনের রিমান্ডে আনার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
গত ১২ মে কলকাতা যাওয়ার পর ১৩ মে হত্যার শিকার হন এমপি আনার। ১৬ মে থেকে তার কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না পরিবার। ২২ মে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত হয় তিনি পরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন। ঢাকায় অপহরণ মামলা ও কলকাতায় হত্যা মামলা হয়েছে। ঢাকায় প্রথমে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান গ্রেপ্তার হন। তারা তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাদের তথ্যে গ্রেপ্তার হন কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু। তিনিও গতকাল ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এদিকে কলকাতা সিআইডি মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করেছে জিহাদ হাওলাদারকে আর নেপাল থেকে সিয়ামকে। এমপি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও এমপির বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন ঢাকা ডিবি ও কলকাতা সিআইডির কর্মকর্তারা। তিনি এমপি আনার হত্যার পর দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে আনতে ভারত ও বাংলাদেশ একযোগে কাজ করছে।