২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। চাঁদের বুকে চতুর্থ দেশ এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম দেশ হিসেবে অবতরণ করেছে ভারতের চন্দ্রযান। ইসরোসহ আরও কিছু ওয়েবসাইট অবলম্বনে সেই চন্দ্রযানের ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভার প্রজ্ঞানে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর কথা জানাচ্ছেন টি এইচ মাহির ও ফয়সল আবদুল্লাহ-
রকেট : চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণে ব্যবহৃত হয়েছে LVM3-M4 রকেট। Launch Vehicle Mark-3 (LVM3)’তে চড়ে ১৪ জুলাই রওনা দেয় চন্দ্রযান-৩। এর উচ্চতা ছিল প্রায় ৪৩.৪ মিটার। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটাতে সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার দ্বিতীয় লঞ্চ প্যাড থেকে ১৪ জুলাই যাত্রা শুরু করে এটি।
তিনটি অংশ : চন্দ্রযান-৩ মোট তিনটি অংশে তৈরি—প্রপালশন মডিউল, ল্যান্ডার ও রোভার।
চারটি ল্যান্ডিং পা এবং চারটি ল্যান্ডিং থ্রাস্টার আছে ‘বিক্রম’ নামের ল্যান্ডারটিতে। যার প্রতিটি ৮০০ নিউটন থ্রাস্ট উৎপাদন করতে সক্ষম। এর ভেতরই ছিল রোভার ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। বিক্রমের মোট ওজন ১৭৫২ কেজি। এর বিদুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৩৮ ওয়াট। চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডারে চারটি ভেরিয়েবল-থ্রাস্ট ইঞ্জিন রয়েছে। যেগুলোর গতি প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়।
বিক্রম ল্যান্ডারে ব্যবহার করা হয়েছে বেশকটি সেন্সর—
** লেজার ইনর্শিয়াল রেফারেন্সিং অ্যান্ড অ্যাক্সিলারোমিটার প্যাকেজ (LIRAP)
** কা-ব্যান্ড অল্টিমিটার (কারা)
** ল্যান্ডার পজিশন ডিটেকশন ক্যামেরা (LPDC)
** ল্যান্ডার হ্যাজার্ড ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যাভয়েডেন্স ক্যামেরা (LHDAC)
** লেজার আলটিমিটার (LASA)
** লেজার, ডপলার ভেলোসিমিটার (LDV)
** ল্যান্ডার হরাইজন্টাল ভেলোসিটি ক্যামেরা (LHVC)
** মাইক্রো স্টার সেন্সর
** ইনক্লিনোমিটার অ্যান্ড টাচডাউন সেন্সর।
** LIRAP সেন্সরটি অভিযোজন এবং ত্বরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাবে। মহাকাশযানটির গতিবিধি নজরদারি করে এটি। তাছাড়া ল্যান্ডিংয়ের সময় চন্দ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে থ্রাস্টারের শক্তি বাড়ায় বা কমিয়েও দেয়।
** KaRA সেন্সর চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে চন্দ্রযানের দূরত্ব নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। যন্ত্রটি কা-ব্যান্ড রেডিও তরঙ্গের একটি পালস চন্দ্রপৃষ্ঠে পাঠায়। ওই পালস চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ফিরে আসার সময় পরিমাপ করে। এভাবেই বের হয় দূরত্ব। একইভাবে কাজ করে LASA সেন্সর। তবে এ সেন্সর চন্দ্রযানের নিচের দিকে পতনের গতি নির্ণয় করে এবং সেই অনুযায়ী গতি নিয়ন্ত্রণও করে।
** চন্দ্রযানে ব্যবহৃত জিপিএস হলো LPDC ক্যামেরা। এটি কোথায় ল্যান্ড করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দেয়। সেন্সরটি অনেকটা আমাদের মোবাইলের ফেস রিকগনিশনের মতো। অবতরণ করার সময় LPDC ছবি তুলতে থাকে এবং AI সফটওয়্যার সেই ছবি বিশ্লেষণ করে ল্যান্ড করার পথ খুঁজে দেয়।
** চাঁদের পৃষ্ঠে গর্ত, উঁচু-নিচু পথ শনাক্ত করবে LHDAC। কোন স্থানটি নিরাপদ ও বিপদমুক্ত তা জানায় এটি। অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে LDV। যাতে আগের মতো চন্দ্রযানটি বিধ্বস্ত না হয়।
প্রজ্ঞানে যা আছে
চাঁদের বুকে বিচরণকারী রোভারটির নাম প্রজ্ঞান। এটি ছয় চাকার যান। পৃথিবীতে এর ওজন ২৬ কেজি। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর বিভিন্ন পরীক্ষা করা, বরফের উপস্থিতি যাচাই করাসহ বিভিন্ন কাজ করবে এটি। চাঁদের মাটি পরীক্ষার জন্য রোভার প্রজ্ঞানে আছে আলফা পার্টিকেল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার এবং লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপ। প্রথমটির কাজ হলো চাঁদের মাটিতে ম্যাগনেশিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, টাইটানিয়াম ও লোহার উপস্থিতি খোঁজা। বিভিন্ন রাসায়নিক গঠন এবং খনিজের উপস্থিতি বিশ্লেষণ করবে দ্বিতীয় যন্ত্রটি। এতে আরও আছে শক্তিশালী নেভিগেশনাল ক্যামেরা, আরএক্স/টিএক্স অ্যান্টেনা, সোলার প্যানেল, হুইল ড্রাইভ অ্যাসেমব্লি, রকার বুগি ইত্যাদি।
চন্দ্রযান-৩-এ এআই
চন্দ্রযান থ্রির সফল অবতরণে ভূমিকা রেখেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তথা এআই। এআই-চালিত সেন্সরগুলো চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি নিরাপদ অবতরণ নিশ্চিত করেছে। ল্যান্ডারটিকে চন্দ্রের ভূ-সংস্থানের পূর্বাভাস দিতে, সম্ভাব্য বিপদ চিহ্নিত করতে এবং দক্ষতার সঙ্গে এর অবতরণ, ঝুঁকি কমাতে এবং নিরাপত্তা বাড়াতে সাহায্য করেছিল।
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোও জানিয়েছে, সম্পূর্ণ এআই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল ল্যান্ডারটি। ল্যান্ডারটির এআই চালিত Lander Hazard Detection and Avoidance Camera (LHDAC) ল্যান্ডিং জোনের টপোগ্রাফি স্ক্যান করেছে। যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে না হয়।
বলা হচ্ছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বরফ থাকবে। আর বরফ মিললে, মিলতে পারে প্রাণের সন্ধানও। তবে এআইর উপযুক্ত ব্যবহার হয় অবতরণের সময়। কেননা এখানে সফল অবতরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে চন্দ্রযান-টু শেষ মুহূর্তে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তাই শেষ ১৫ মিনিট সফট ল্যান্ডিংয়ের জন্য AI ব্যবহার করা হবে। ISRO চেয়ারম্যানের মতে, মূল AI সিস্টেম হলো ল্যান্ডারের বোর্ডে নেভিগেশন, গাইডেন্স এবং কন্ট্রোল সিস্টেম। তাছাড়া চন্দ্রযানের বিভিন্ন সেন্সর সহায়তা করবে সফল চন্দ্র অভিযানে।
মন্তব্য করুন