আবিদ রাইহান
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাগদাদের ঐতিহাসিক লাইব্রেরি

বাইতুল হিকমাহ

বাইতুল হিকমাহ
বাইতুল হিকমাহ

ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় হলো ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এক সময় যখন বাগদাদের রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠাগার পর্যন্ত জ্ঞানচর্চায় মুখর ছিল। এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর অন্যতম হলো ‘বাইতুল হিকমাহ’ (জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কেন্দ্র), যা শুধু একটি গ্রন্থাগার নয়, বরং ছিল জ্ঞানচর্চার, অনুবাদের এবং গবেষণার এক যুগান্তকারী কেন্দ্র

প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট

বাইতুল হিকমার সূচনা হয় খলিফা হারুন আল-রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময়ে। তবে এর প্রকৃত বিকাশ ঘটে খলিফা আল-মামুনের (৮১৩-৮৩৩) অধীনে। আল-মামুন ছিলেন দর্শন, বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। তার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগেই বাইতুল হিকমাকে একটি বিশ্বমানের গবেষণা ও অনুবাদ কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়। এ সময় অনেক বিদ্বান ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনুবাদকর্মে নিযুক্ত ছিলেন এবং তাদের শ্রমে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক অসাধারণ জ্ঞানের ভান্ডার।

অনুবাদের বিপ্লব

বাইতুল হিকমাহ ছিল একটি বিপুল অনুবাদ প্রকল্পের কেন্দ্র। গ্রিক, সিরিয়াক, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার অসংখ্য দর্শন, চিকিৎসা, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয় এখানে। আল-কিন্দি, আল-খোয়ারিজমি, হুনাইন ইবন ইসহাক, সাবিত ইবন কুররা প্রমুখ অনুবাদক ও গবেষক বাইতুল হিকমাকে পরিণত করেন বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের এক স্মারকে। শুধু প্রাচীন জ্ঞানকোষ নয়, তারা নিজেরাও মৌলিক চিন্তা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

ধ্বংস ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টা

বাইতুল হিকমার চূড়ান্ত ধ্বংস ঘটে ১২৫৮ সালে, যখন মঙ্গোল সেনাপতি হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন। বাগদাদ শহর তছনছ হয়ে যায়, অসংখ্য মানুষ নিহত হন আর দজলা নদী হয়ে ওঠে রক্তাক্ত ও কালিময়—যত বই নদীতে ফেলা হয়েছিল, তার কালি নদীর জল রঙিন করে তুলেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। তবুও এ বিপর্যয়ের মধ্যেও কিছু মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রক্ষা পায়। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নাসির আল-দিন আল-তুসি পরিস্থিতি আঁচ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মারাগার মানমন্দিরে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। তার এ উদ্যোগের ফলে বাইতুল হিকমার কিছু উত্তরাধিকার পরবর্তীকালের বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

প্রভাব ও উত্তরাধিকার

বাইতুল হিকমার প্রভাব নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছু বিতর্ক থাকলেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অনেক অনুবাদকর্মের উৎস হিসেবে বাইতুল হিকমার নাম থাকলেও সব অনুবাদ সেখানে হয়নি, বরং এটি ছিল একটি প্রেরণা—যে অনুপ্রেরণায় মুসলিম বিশ্বজুড়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার প্রবণতা শুরু হয়। ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম ১০০৫ সালে কায়রোতে দারুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রায় ১৬৫ বছর বাইতুল হিকমার সমসাময়িক একটি বিদ্যাপীঠ হিসেবে টিকে ছিল। একইভাবে অন্যান্য অঞ্চলেও ‘দারুল ইলম’ বা ‘জ্ঞানঘর’ তৈরি হতে থাকে। অন্যদিকে কর্দোবার খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম স্পেনে বিশাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে পাঁচ লাখের বেশি পাণ্ডুলিপি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় আন্দালুসিয়ার টলেডো শহর দ্বাদশ শতকে হয়ে ওঠে ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের মিলনকেন্দ্র। এখানেই আরবি গ্রন্থ থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদের একটি বিশাল ধারা গড়ে ওঠে, যা ইউরোপের রেনেসাঁর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। বাগদাদের বাইতুল হিকমা শুধুই একটি গ্রন্থাগার নয়; এটি ছিল এক নতুন সভ্যতার নির্মাণশালা। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পণ্ডিতরা একত্রিত হয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন বিশ্বময়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

আজকের দিন কেমন কাটতে পারে, জেনে নিন রাশিফলে

ঢাকার বাতাস সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’

টানা ৫ দিন বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

জাপানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

টিভিতে আজকের খেলা

২৮ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২৮ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

‘হোমিও-ইউনানি-আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রতিবেদন বৈষম্যপূর্ণ’

১০

মধ্যরাতে দোকানে দোকানে সেনাবাহিনী, গ্রেপ্তার ১০

১১

শেকৃবির রেজিস্ট্রার পদে রুটিন দায়িত্বে নজরুল ইসলাম

১২

সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ‘সুরভি’ : ডা. জুবাইদা

১৩

ধোলাইয়ের শিকার দুই ইরানি করলেন মামলা

১৪

জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে বিএসপিপির ২ দিনের কর্মসূচি

১৫

মধ্যরাতে ঢাকায় ভূমিকম্প

১৬

দ্রুত পল্লী বিদ্যুতের দাবি মানার আহ্বান হামিদুর রহমান আযাদের

১৭

স্বাস্থ্য পরামর্শ / রাতে পানি পান: কখন উপকারী, কখন ক্ষতিকর

১৮

নতুন এক জেলা ঘোষণার পক্ষে সারজিস আলম

১৯

ঢাবিতে অপ্রীতিকর অবস্থায় আটক ২ বহিরাগত, থানায় সোপর্দ

২০
X