‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম’—সৈয়দ আশরাফ, আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদকের এ উক্তিটি নিয়ে আজ অবধি দল বা দলের বাইরে কেউ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বলে জানা যায়নি। বরং আজ যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে বিদেশিদের তৎপরতায় আওয়ামীবিরোধী পক্ষটি দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখনো আওয়ামী লীগের মূল শক্তিটি আসলে কোথায়—তা নিয়েও কোথাও কোনো আলোচনা লক্ষ্যমান নয়। দুঃখজনক সত্য হলো, আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে এক ধরনের শৈথিল্য ও একজনের ওপর সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং আরও ভয়ংকর হলো, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ কেউ ব্যক্তিগত ও প্রকাশ্যে বিদেশিদের তৎপরতার সঙ্গে সুর মেলানোরও চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে দলটির জন্য চরম বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে। আজকের আলোচনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। যদিও এত পুরোনো এবং অভিজ্ঞ একটি রাজনৈতিক শক্তির জন্য কোনো পরামর্শ হাস্যকর শোনাতে পারে; কিন্তু বিশ্লেষকেরও একটি ‘পারসপেক্টিভ’ থাকতে পারে এবং সেটা লিখেই উপস্থাপন করা যুক্তিসংগত মনে করছি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় তিনটি রাজনৈতিক দলকে কখনোই আমরা এক ধরনের—বিশেষ করে ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতির’ প্রশ্নে একপর্যায়ের বলে মনে করতে পারি না। কারণ, তাদের জন্ম প্রক্রিয়া ও রাজনীতি একই ধরনের নয়। মোটা দাগে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এমন দুটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে, যা অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে গঠিত হয় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারে তাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠাসহ বার বার ক্ষমতায় আরোহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ক্ষমতার জোরে, অর্থে এবং কৌশলে দল দুটি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে এবং তারা মূলত একই চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্ম এবং বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়া ও বয়স বেড়ে পঞ্চাশ পেরোনো পুরোটাই এত বেশি সম্পর্কিত যে, এ বিষয়ে বলতে গেলে একটি পুরো পিএইচডি সন্দর্ভ লেখা সম্ভব, যা এই নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করবে শুধু। এই যে তিনটি রাজনৈতিক দলের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য এখানেই নিহিত রয়েছে কথিত ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর মাজেজা, এটা বাস্তবিক কারণেই সম্ভব নয় এ কারণে যে, আওয়ামী লীগবিরোধী বাকি দুটি দল এমনকি জামায়াতে ইসলামীসহ এক সময়ে নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতা তথা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত ও লালিত হওয়ায় তারা যে সুবিধা সবসময় পেয়ে এসেছে, তা আওয়ামী লীগকে পেতে হয়েছে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে। বরং এ-ও সত্য যে, ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা যেভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ ঠিক ততটাই সক্ষমতার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা শুধু নয়—শক্তিশালী থাকার প্রমাণ দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই অমোঘ বাস্তবতা মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ কিংবা বাকি রাজনীতির বিশ্লেষণ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যদিও সেটা খুব কম বিশ্লেষকের আলোচনাতেই আমরা পাই। উপরন্তু বাংলাদেশের একদল সুশীল রাজনৈতিক পক্ষ নিজেদের অ-রাজনৈতিক দাবি করে আওয়ামী লীগকেও বাকি রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে এক পাল্লায় মেপে নিজেদের ‘নিরপেক্ষতার’ প্রমাণ দিয়ে থাকেন। তারা ইতিহাসকে অস্বীকার করে যে কোনো পরিস্থিতির আপাত বিশ্লেষণকে হাজির করেন। ফলে সব দোষ আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপানোয় তারা বিস্ময়করভাবে সফলতার প্রমাণ দেন।
এ অবস্থায় দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাটা আওয়ামী লীগের পক্ষে সহজ কাজ ছিল না। শেখ হাসিনার মতো বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা না থাকলে দলটির পক্ষে এত এত প্রতিপক্ষকে সামাল দিয়ে টিকে থাকতে পারত কি না, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে। আওয়ামী লীগের শত্রু কেবল দেশের রাজনীতিতে নয়, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও আমরা দেখতে পাই যে, আওয়ামী লীগ কিছু স্থায়ী শত্রু তৈরি করে রেখেছে পাকিস্তানের নিগড় থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে। এই যে স্থায়ী শত্রুতা, তা আসলে মিত্রতায় পরিণত করার কোনো কৌশল আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে; কিন্তু সেই আপাতভাবে এই দেশি ও বিদেশি শত্রুদের নিয়েই আওয়ামী লীগকে টিকে থাকতে হচ্ছে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এমন এক অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে ফেলেছে যে, তাকে অস্বীকার করাটা আওয়ামী লীগের শত্রুদের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না।
এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করার জন্য আওয়ামীবিরোধী চক্র উঠে-পড়ে লেগেছিল। দিনরাত জপ শুরু করেছিল যে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু কিছুদিন পরই তাদের গলার স্বর মিইয়ে আসতে শুরু করে আর এখন বিষয়টি তারা বেমালুম ভুলে গেছে বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনা সরকারের অর্জনকে এমনকি তার শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারছে না। কারণ, এখন যখন তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলনের জন্য নেমেছে তখন দেখতে পাচ্ছে, দেশের প্রতিটি কোণেই শেখ হাসিনার হাত পৌঁছেছে এবং উন্নয়নকে তামাশার বিষয়বস্তু করে পার পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি কথিত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরাও সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো ভুল, ত্রুটি বা অন্যায় খুঁজে বের করার সুযোগ পাচ্ছেন না, ফলে তাদের লেখালেখিও আজকাল আর বেশি চোখে পড়ে না। একথা বলার সুযোগ মোটেও নেই যে, সরকার গৃহীত প্রকল্পে কোনো প্রকার দুর্নীতি হয়নি, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এমনকি উন্নত দেশেও বড় বড় প্রকল্পে কমবেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়ন অর্থনীতিতে এই দুর্নীতিকে গ্রাহ্য করা হয় এবং এসব মেনে নিয়েই এগোনোর কথা বলা হয়। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনো ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি রোবট’ দ্বারা বাস্তবায়িত হয় না, হয় মানুষ দিয়ে এবং মানুষের লোভ-লালসাকে কোনো অর্থনীতিবিদই অস্বীকার করেন না।
বাংলাদেশের মানচিত্রকে সামনে নিয়ে বসে ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশকে যদি কেউ লক্ষ করেন তাহলে দেখতে পাবেন, কেবল মেগা প্রকল্পই নয় অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রকল্পে বাংলাদেশ এখন কেবল যুক্তই নয়; বরং সমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় বদল এসেছে, জীবনমানে এসেছে পরিবর্তন। স্বাস্থ্য খাতে গ্রামীণ জীবনেও কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো বিনামূল্যে সাধারণ চিকিৎসায় যে ধরনের সাফল্য শেখ হাসিনার সরকার অর্জন করেছে, তা আসলে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। নারীর ক্ষমতায়ন এদেশে এখন একটি বাস্তবায়িত প্রপঞ্চ। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আসা মানুষগুলো এখন প্রতি নিঃশ্বাসে সরকারের প্রশংসা করেন এবং তাদের জীবনে আসা এই মৌলিক পরিবর্তনের জন্য কৃতজ্ঞও। আওয়ামী লীগ কেবল দেশ স্বাধীন করায় নেতৃত্বই দেয়নি, দেশের মানুষের সব ধরনের ‘মুক্তির’ লক্ষ্যে ঘোষিত ‘মেনিফেস্টো’ অনুযায়ী কাজ করে গিয়েছে এবং আজ সেসব বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের অন্যসব রাজনৈতিক দলের চেয়ে আলাদা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। খুব ছোট আলোচনায় এর চেয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। কারণ, আওয়ামী লীগের হাত ধরে আসা কেবল মৌলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে আলোচনা করতেই দীর্ঘ কলেবরের লেখা প্রয়োজন।
এই যে এতগুলো দৃশ্যমান সাফল্য—যা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কাছেই নতুন করে প্রমাণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, সেগুলো নিয়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি এই রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে কোনো প্রোগ্রাম নিয়ে মাঠে রয়েছে? না, বিএনপির আন্দোলনবিরোধী ‘শান্তির জন্য পদযাত্রা’র মতো প্রোগ্রাম নয়, সাধারণ জনগণের দরজায় গিয়ে নিজেদের অবস্থান, শেখ হাসিনা তথা সরকার গৃহীত প্রকল্প থেকে জনগণের কী উপকার সাধিত হয়েছে, তা বোঝানোর জন্য কোনো অনুষ্ঠান কি আদৌ চোখে পড়ছে? আমার পড়েনি; বরং দেখতে পাচ্ছি যে, আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা অ-আওয়ামী লীগাররা এখন দেশি-বিদেশি চাপের মুখে পড়া সরকার দল থেকে বের হয়ে নিজেদের চেহারা দেখাতে শুরু করেছে এবং কোথাও কোথাও এমন সব বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন যে, মনে হতে পারে তারা আসলে আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করেন। আসলেই তারা সেটা করতেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার হাত ধরে তারা এতদিন দলের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে সব সুবিধা ভোগ করে এখন নতুন সরকারের জন্য কাজ করার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। যদিও তারা নিশ্চিত নন যে, নতুন সরকার আওয়ামী লীগ, নাকি অন্য কেউ। কারণ, শেখ হাসিনা একাই তার যুদ্ধটি লড়ে চলেছেন বলে এখন পর্যন্ত এমন কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়, যাতে মনে হতে পারে যে, আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ আগামীতে সরকার গঠন করতে পারে। ফলে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন; কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়াতে তারা নিরলস কাজ করে চলেছেন বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই বোঝা যায়।
এ অবস্থায় প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের করণীয় কাজটি আর কিছুই নয়, শুধু কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কর্মসূচির জন্য অপেক্ষা না করে দেশের সব স্তরে নিজেদের সক্ষমতা নিয়েই জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণকে এ কথাটিই বোঝানো যে, সরকার গত ১৫ বছর ধরে যেমন দেশের পক্ষে, দেশের জন্য, মানুষের পক্ষে ও মানুষের জন্য কাজ করছে আগামীতেও সেটিই করবে। দোষত্রুটি যা আছে সেগুলো স্বীকার করে মানুষের সামনে ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হওয়াটাই হবে মূল করণীয়। এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলেই লেখাটি লিখতে হলো, আশা করি বিষয়টি নিয়ে দলটি ভাবছে এবং পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করছে।
লেখক: এডিটর ইনচার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি
মন্তব্য করুন