পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৪ এএম
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা দিন

গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা দিন

লিখতে লিখতেই খবরে পড়লাম, ছাত্রনেতারা সেনা বা অন্য রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এমন সরকার ছাড়া কোনো সরকার মানবেন না—এ ঘোষণা করেছেন। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ! অভিনন্দন!

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শেষ অবধি নীরবতা ভঙ্গ করছি!

এক মাসের কিছু আগে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের ওপর সে দেশের সরকার ক্রমাগত যে আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে, তা ন্যক্কারজনক এবং বর্বরোচিত তো বটেই, একচ্ছত্র ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকের মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ার চরম উদাহরণও বটে। আমরা সবাই কমবেশি জানি, এ আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা কেন্দ্র করে শুরু হলেও সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক এবং একনায়কোচিত পদ্ধতি নিয়ে জমতে থাকা মানুষের রাগ ফেটে বেরিয়ে এ আন্দোলনকে এক বৃহৎ চেহারা দেয়, যা আজ এক চরম পরিণতি পেয়েছে!

সরকারের পদত্যাগ যদি ছাত্রদের সর্বশেষ এবং একমাত্র দাবি বলে ধরে নিই, তাহলে তাদের অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হয়! কিন্তু এ প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন না তুলে পারছি না। অনেকের কাছে অপ্রিয় হতে পারি জেনেও এগুলোকে প্রশ্ন না অনুরোধ বলব, ঠিক জানি না। হয়তো দুটোই!

বাংলাদেশের সেনাপ্রধান তার বিবৃতিতে বললেন এবং পরে তা ছাপার অক্ষরে পড়লামও যে, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আলোচনা করেছেন সুশীল সমাজ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত নেতৃত্বের সঙ্গে! কথা হলো, আন্দোলন তো করলেন আপনারা ছাত্ররা! ...এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি দেখলাম একটি পোস্ট দিয়েছেন, ‘যে মসজিদ থেকে মানুষকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন, সেই মসজিদ থেকেই সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার ডাক দিন!’ আরেকটি পোস্টে পড়লাম, ‘কালীবাড়ি রক্ষা করছেন মাদ্রাসার ছাত্ররা।’ সত্যিই ভালো লাগল পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের প্রয়োজন পড়ছে কেন?

‘বিজয়োল্লাসে’ মত্ত কিছু মানুষ দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙছেন, গণভবন লুটপাট করছেন। শুনলাম ৩২ নম্বর ধানমন্ডি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে! কারাগার ভেঙে দেওয়ায় বন্দিরা পালাচ্ছে। সাবেক শাসক দলের সাংসদদের বসতবাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকি পিটিয়ে হত্যাও চলছে। বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক তথা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাশরাফীর বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়েছে।

যে আন্দোলন ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে, গর্বিতভাবে দেশের পতাকা মাথায় এঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন আপনারা, ছাত্ররা, বিশ্বাস করি না তারা এ কাজগুলো করতে পারেন! তাহলে? ওতপেতে থাকা কিছু স্বাধীনতাবিরোধী, কট্টরপন্থি শক্তি আপনাদের এ অসামান্য আন্দোলন হাইজ্যাক করে ফেলছে না তো? আপনার হয়তো বলবেন ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ। কিছু বেনোজল তো ঢুকবেই! মানুষ এতদিনের রাগ একটু তো দেখাবেই!’ হয়তো তা-ই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, আন্দোলন থেকে এদের সরিয়ে রাখা বোধহয় এই আন্দোলনের স্বার্থেই দরকার!

আসলে ঘরপোড়া গরু তো! সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় হয়। বারবার শুনছি ‘বাংলা বসন্ত’ বলা হচ্ছে এই মুভমেন্টকে! মনে পড়ছে ‘আরব স্প্রিং’-এর কথা। আর এ-ও মনে পড়ছে যে, সেই বসন্তের ফল অধিকাংশ জায়গায় ভালো হয়নি। কট্টরপন্থি মৌলবাদী শক্তি হাইজ্যাক করেছে সেই মুভমেন্টকে, মধ্যপ্রাচ্য তলিয়ে গেছে গৃহযুদ্ধ এবং অশেষ রক্তপাতের গহ্বরে। আমি যে দেশের নাগরিক, সেই দেশেও কিন্তু যন্তর মন্তরে আন্না হাজারের সমর্থনে আন্দোলন, ভ্রষ্টাচারবিরোধী আন্দোলন দশ বছর আগে ডেকে এনেছিল এমন এক শক্তিকে, যার নীতিগত বিরোধিতা আমাদের মতো লোকেরা আজও করে চলেছি! এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, ভারতের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের ফল কিন্তু কিছুটা হলেও প্রমাণ করে দিয়েছে, শত মেরূকরণ সত্ত্বেও মানুষ কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, সংবিধান দ্বারা চালিত হতে চান!

নাহ, কুডাক ডাকত চাই না মোটেই। বরং আশা করতে চাই যে, আপনারাও তা-ই চান এবং চাইবেন! আর ওপরে করা প্রশ্নগুলো সামনে রেখে এবার অনুরোধ করতে চাই। আজ আপনাদের গৌরবের দিন! যে গর্বের আঁচ আমাদের গায়েও এসে লাগছে! নিশ্চয়ই উল্লাসেরও দিন! কিন্তু স্বৈরাচারকে পরাস্ত করার এই আনন্দকে কালিমালিপ্ত হতে দেবেন না! এক ফ্যাসিস্টকে সরিয়ে আরও বড় ফ্যাসিবাদকে জায়গা করে দেবেন না! গণতন্ত্রকামী এই আন্দোলনকে সসম্মানে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা দিন, শুধু গলার জোরে! গায়ের জোরে নয়।

লিখতে লিখতে এখনই খবরে পড়লাম, ছাত্রনেতারা সেনা বা অন্য রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এমন সরকার ছাড়া কোনো সরকার মানবেন না এই ঘোষণা করেছেন এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন! প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ! অভিনন্দন!

পরিশেষে বলি, ঢাকার শাহবাগে বা টিএসসিতে আমার যে বন্ধুরা উৎসবে মেতেছেন, তাদের ক্ষুণ্ন করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষই তৈরি করবেন। সেটাই উচিত এবং সেই সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নিশ্চয়ই নেই। করতে আমি চাইও না! আমি ভারতীয়। কিন্তু যারা আমাকে চেনেন, বিশেষত আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা, তারা জানেন, আমার কাছে আমার ‘বাঙালি’ পরিচয়টা কতটা গর্বের! বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আর পাঁচজন ভারতীয়র মতো ‘পেশাদার’ তো নয় বটেই, আর পাঁচজন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মতোও নয়! সম্পর্কটি অনেক বেশি আত্মিক এবং প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তার! টানটা নাড়ির! তাই হয়তো একটু অনধিকার চর্চাই করে ফেললাম! মাফ করবেন!

লেখক: ভারতীয় অভিনয়শিল্পী

নিবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেওয়া

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কার্যক্রম স্থগিত, যা বললেন আখতার  

বাফুফে থেকে সালাউদ্দিনের বিদায়

নারী মৈত্রীর চাকরি মেলায় তরুণ নারীদের ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সামিটে হাজির হলেন সৌদি রাজকুমারী

পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে বিপাকে চীন

আ.লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে নানকের বার্তা

৪০ দিন ধরে বিছানায় কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ ইয়াকুব

সচিবালয়ে প্রভাব বিস্তারকারী তানভীর সমন্বয়ক নয় : বাকের

এখনো ঢাকায় আসেনি জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দল’ 

এক দফা দাবিতে আন্দোলনে কৃষি ব্যাংকের ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তারা 

১০

মোহাম্মদ সাব্বিরের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের শোক

১১

পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

১২

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ

১৩

বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবি, ৩ জেলের মরদেহ উদ্ধার

১৪

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা খুন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ

১৫

বাংলাদেশের বিপক্ষে উইকেট বদলে ফেলছে ভারত?

১৬

সেই সেনা সদস্যকে সম্মাননা প্রদান

১৭

গুলিবিদ্ধের ৪০ দিন পর মারা গেলেন সাব্বির 

১৮

জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন নিয়ে যা বললেন নায়ক নাঈম

১৯

দুদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই উপকূলে, বরফ সংকটে জেলেরা

২০
X