আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের অহংকার এবং বাঙালি জাতিরও অহংকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিদায়ী সরকার অনেক তির্যক মন্তব্য করেছে। আমরা ব্যাংক থেকেও প্রতিবাদ করতে পারিনি। এ নিয়ে লেখালেখিতেও অনেক বাধা ছিল। তার প্রশংসা করলেই শাস্তিমূলক বদলি আশঙ্কা ছিল। এ ভয়ে গত ১৫ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের এ মহান ব্যক্তিটি নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক সমস্যাও হয়েছে। অথচ এ মহান ব্যক্তিটির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কিন্তু প্রাণের গ্রামীণ ব্যাংক। এটা হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার পেছনে স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। সদস্যদের সাক্ষরতা শিখিয়ে তাকে ঋণ দেওয়া, শিক্ষকের মতো ভূমিকা নিয়ে ঋণের মাধ্যমে কীভাবে স্বাবলম্বী করা যায় এবং তাকে কাজে লাগানো যায়, সেটা কীভাবে করতে হয় পরম মমতা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন।
বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫১টি ব্যাংক আছে। এর কর্মীরা শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় না। শহরের চাকচিক্য থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালায়। তা ছাড়া সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি রাজনৈতিক পেশিশক্তির প্রভাবে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব। দালিলিক কাগজপত্রের জটিলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়। সেজন্য গ্রামের জনগণ তাদের কাছে যেতে পারে না। অন্যদিকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এবং আর্থসামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গে তারা যাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, নিজেরা যাতে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে—সেটাই গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। প্রফেসর ইউনূস স্যারের দর্শন হলো ব্যাংক যাবে ঋণগ্রহীতার বাড়িতে। অর্থাৎ কর্মীরা ব্যাংকিং সুবিধা তার ঘরে পৌঁছে দেবে। এ কাজগুলো প্রফেসর ইউনূসের সৈনিকরা সততার সঙ্গে করে থাকে বিধায় গ্রামের মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক খুবই জনপ্রিয় এবং আস্থার জায়গা। বর্তমানে দেশব্যাপী এর কার্যক্রম আছে। শাখার সংখ্যা ২ হাজার ৫৬৮টি। আমানতে ব্যালান্স ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায়যোগ্য ঋণের ব্যালান্স ১৭ হাজার কোটি টাকা। আদায় হার ৯৭ শতাংশ। আদায়যোগ্য ঋণের তুলনায় আমানতের শতাংশ ১৫৩। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে বিশ্বের ৯৭টি দেশে এর কার্যক্রম চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে গ্রামীণ আমেরিকা।
বিশ্বের বহু দেশের গুণীজন, সাংবাদিক, ছাত্রছাত্রী আসে এই গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর গবেষণা করতে, কিছু শিখতে ও জানতে। এ গবেষণা কাজের জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে নির্ধারিত ফি দিতে হয়। বর্তমানে দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের সফলতা দেখে অনেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তারাও ভালো সফলতা পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ। অর্থাৎ ৪ কোটি ২০ লাখ জনগোষ্ঠী গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত।
একেবারে নিম্নস্তর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনে এবং পৃথিবী থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। নোবেল প্রাপ্তিতে হঠাৎ করে দেশ যেন জেগে উঠল। সারা বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। প্রিন্ট মিডিয়ায় কেউ কেউ নিউজে হেডলাইন করেছে—‘বাংলাদেশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে’। সারা দেশে অসংখ্য ব্যানার পোস্টার ছেয়ে গেল—প্রফেসর ইউনূস স্যারকে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল, স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসেছিল স্যারকে অভিনন্দন জানাতে। সরকার-বিরোধীদলীয় মন্ত্রী-এমপিরাও এসেছিলেন শুভেচ্ছা জানাতে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ছিল খবর সংগ্রহে সরব। ধন্য বাংলাদেশ ধন্য প্রফেসর ইউনূস ধন্য গ্রামীণ ব্যাংক—সবার মুখে তাই ছিল। প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পাবে আমরা তা শুনে আসছিলাম ১৯৯৪ সাল থেকে। এটা হঠাৎ করে হয়নি। প্রতি বছরই বিবেচনায় তার নাম আসত। এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। পাশের দেশ ভারত থেকে প্রফেসর ইউনূস তিনটি সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার। সেটা কি অর্থের বিনিময়ে হয়েছে? আমেরিকার সেরা দুটি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন—প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কনগ্রেস গোল্ড মেডেল পুরস্কার। তা ছাড়া জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, ইতালি, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই স্যারের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। যারা নিমন্ত্রণ করে তারা বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করে। তিনি বাংলা ও ইংরেজির সুবক্তাও বটে। কিন্তু আওয়ামী সরকার তা মূল্যায়ন করেনি। তিনি ভারতের লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। বছর দুই আগেও আসামের রাজ্যসভায় বক্তব্য রেখেছেন। বার্লিন দেয়াল ধ্বংসের ২০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জার্মানিতে যখন বক্তব্য রাখেন, তখন ইউরোপের সব সরকারপ্রধান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য টিকিট কেটে শুনছিলেন। তিনি সারা বিশ্বের সামাজিক ব্যবসারও উদ্যোক্তা। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন দেশে সম্মেলনও করে যাচ্ছেন। ড. ইউনূস অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন পছন্দ করেন। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের ব্যাংক, অযথা আমাদের খরচ করতে অনুমতি দেননি। তিনি যখন এমডি ছিলেন, কাঠের চেয়ারে বসতেন। এ ধারা ম্যানেজার থেকে শুরু করে সবার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চালু আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে অর্থ পাচারকারী, সুদখোর, ঘুষখোর আর কত কী উপাধি দিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীও যাচ্ছেতাই মন্তব্য করলেন। এর প্রতিবাদে ফিল্ড পর্যায়ে আমরা মানববন্ধন করি। সরকার কিছুই তোয়াক্কা না করে অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। এমনকি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যা খুশি তাই মন্তব্য করেছে। মনে হচ্ছে যেন শেখ হাসিনা নোবেল না পাওয়ায় এত যন্ত্রণা। যে দেশে গুণীজনের সম্মান নেই, সে দেশে গুণীজন জন্মায় না। সেটা আমাদের বুঝতে সময় লাগল সেটাই সবচেয়ে বড় আফসোস। গত ১৫ বছর আমরা স্যারকে দেশের কাজে লাগাতে পারিনি। স্যার বলেছিলেন, সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই কিন্তু সহযোগিতা না নিয়ে মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখল। এতে ক্ষতি কার হলো, অবশ্যই বাংলাদেশের।
নরওয়েতে সম্প্রসারিত প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে জোরালো তদন্ত করা হলো অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি তা তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করলেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদ নেয় এটাও রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। তাই তো গ্রামীণ ব্যাংক হাজারো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান।
স্বৈরাচার সরকার পতনের পরপর স্যারের প্রিয় কর্মীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সব কার্যালয়ে স্যারের ছবি আবার টানানো শুরু করেছেন। এ ছবি আমাদের শক্তি দেয়, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগায়। সততা শেখায়। ছবি অপসারণের বিষয়টি সহজভাবে কেউ তখন মেনে নেয়নি। সবার মনে ভীষণ দাগ লেগেছিল। আমাদের ব্যর্থতা প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছি। এই সাইফুল মজিদ কী কী অনিয়ম গ্রামীণ ব্যাংকে করেছেন, তা সংবাদপত্রে আমার লেখার ইচ্ছে আছে। ব্যাংকের অর্থ ব্যয় করে তিনি হিরো সাজতে চেয়েছিলেন, আজ তিনি ব্যাংকে অবাঞ্ছিত। গ্রামীণের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গেঁথে আছেন এবং তা থাকবে আজীবন। কেউ তার সম্মান কেড়ে নিতে পারবে না। স্যার আমাদের শিখিয়েছেন—ঋণ আমাদের মৌলিক অধিকার, প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার করে দেশ একদিন এগিয়ে যাবে, ভালো কাজ করতে হলে ক্রমাগত ভাবতে হবে। আমরা এগুলো ধারণ করে আছি এবং থাকব। আজ দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে স্যার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ায় আমরা গর্বিত। তার হাতেই আমাদের দেশ সুরক্ষিত থাকবে, গতি হারাবে না প্রিয় মাতৃভূমি। আশা করি দেশবাসী সবাই মিলে স্যারকে সহযোগিতা করবে। আমরা স্যারের সহকর্মী হিসেবে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মিডিয়া সেল, গ্রামীণ ব্যাংক