আবু তাহের
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৪, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতির সংকট কীভাবে কাটবে

অর্থনীতির সংকট কীভাবে কাটবে

বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও বর্তমানে জটিল এক সমস্যার সম্মুখীন। জুলাই মাসের পিএমআই সূচকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রধান চারটি খাতই সংকোচনের মুখে। পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স বা পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর নিচে নেমে এসেছে। মেট্রোপলিটন চেম্বার ও পলিসি এক্সচেঞ্জ প্রণীত সর্বশেষ পিএমআই সূচকের মান জুলাই মাসে ৩৬ দশমিক ৯-এ নেমে এসেছে; আগের মাসে যা ছিল ৬৩ দশমিক ৯। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দেশে পিএমআই সূচকের মান কমেছে ২৭ পয়েন্ট। আর এ সংকোচনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

পিএমআই সূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা—এ চারটি খাতই একযোগে সংকোচনের সম্মুখীন। কৃষি খাতে সবচেয়ে বড় ধরনের সংকোচন লক্ষ্য করা গেছে। অস্থিরতার কারণে কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটার এবং কৃষিপণ্যের বাজারে অনিশ্চয়তার ফলে এ সংকোচন হতে পারে। কৃষি খাতে পিএমআই সূচক জুন মাসে ৭০ দশমিক ২ পয়েন্টে দাঁড়ায়, যা মে মাসে ছিল ৭৯ দশমিক ৩ পয়েন্ট। কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ এবং এ খাতের সম্প্রসারণের গতি কমে যাওয়া দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরে ধারাবাহিক জটের কারণে পণ্য পরিবহনে সময় এবং ব্যয় বেড়েছে, যা কৃষিপণ্য সরবরাহে বিলম্ব ঘটিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়া এবং ঈদুল আজহার ছুটি কৃষিকাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

অন্যদিকে, উৎপাদন খাতেও উল্লেখযোগ্য সংকোচন লক্ষ্য করা গেছে। অস্থিরতার কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটার ফলে এ সংকোচন হতে পারে। জুন মাসে উৎপাদন খাতের পিএমআই সূচক সবচেয়ে বেশি কমেছে। নেমে এসেছে ৬১ দশমিক ৭ পয়েন্টে, যা মে মাসে ছিল ৭৬ দশমিক ৩ পয়েন্ট। এই খাতে সংকোচনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সরবরাহের জটিলতা এবং নতুন ক্রয়াদেশের সংখ্যা হ্রাস। দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রামে সৃষ্ট জটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা উৎপাদনকারীদের পণ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেক দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নির্মাণ খাত, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি, তার পিএমআই সূচক জুন মাসে কমে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ১ পয়েন্টে, যা মে মাসে ছিল ৭৪ দশমিক ৩ পয়েন্ট। নির্মাণ খাতে সংকোচনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট এবং অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, সরবরাহে বিলম্ব এবং নতুন নির্মাণ প্রকল্পের সংখ্যা হ্রাস। এ ছাড়া ঈদের ছুটির কারণে নির্মাণ খাতে কার্যক্রম কিছুটা শ্লথ হয়। দেশব্যাপী খারাপ আবহাওয়ার কারণে অনেক নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ ছিল, যা সামগ্রিকভাবে খাতটির সম্প্রসারণের গতি কমিয়েছে।

সেবা খাতের পিএমআই সূচক জুন মাসে দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৫ পয়েন্টে, যা মে মাসে ছিল ৬৪ দশমিক ৩ পয়েন্ট। অন্যান্য খাতের তুলনায় সেবা খাতের সংকোচন কম হলেও, এটি অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। সেবা খাতে প্রধানত পরিবহন, ব্যাংকিং, বীমা, এবং স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রাম বন্দরের জট এবং সরবরাহ শৃঙ্খলায় সমস্যা সেবা খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বীমা খাতে নতুন পলিসি গ্রহণের সংখ্যা হ্রাসও এই খাতে সংকোচনের কারণ।

সামগ্রিক এ প্রতিবন্ধকতাগুলোর ফলে আমরা বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়েছে। দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগই কমেছে। ফলে নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে না, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ। অস্থিরতার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। পরিবহন খরচ, কাঁচামালের দাম, শ্রমিকদের বেতন ইত্যাদি সবকিছুই বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়ছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মুদ্রার মূল্য অস্থির হয়ে পড়েছে। এটি আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং রপ্তানি কমিয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং ঋণ পরিশোধের হার কমে যাওয়ার ফলে ব্যাংক খাতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতি মন্দার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। ফলে সরকারি খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে, যা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে সংকটের মুখোমুখি, তা শুধু একটি সংখ্যা বা একটি সূচকের হ্রাসের চেয়ে অনেক বেশি গভীর। এটি একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার মতো একটি বিষয়। পিএমআই সূচকের তথ্য শুধু একটি নির্দেশক। এর পেছনে কাজ করছে অনেক জটিল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল একটি প্রধান ট্রিগার, তবে এর প্রভাব বিস্তৃত। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: সর্বপ্রথম, রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। সব রাজনৈতিক দলকেই দেশের স্বার্থে একত্রিত হতে হবে। যদিও এটি একটি কঠিন ও দুরূহ কাজ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি খুবই জরুরি একটি বিষয়।

বিনিয়োগ আকর্ষণ: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। বিশেষ করে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

উৎপাদন খাতের পুনরুজ্জীবন: উৎপাদন খাতকে সহায়তা করার জন্য সরকারকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির দাম কমানো, কাঁচামাল আমদানিতে সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ: কৃষি খাতকে আধুনিকীকরণ করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষি গবেষণা, সার, বীজ, সেচ ইত্যাদিতে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা: গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এতে করে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।

শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশ: মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে মানুষকে কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।

সুশাসন: দুর্নীতি দমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং অর্থনীতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

এ ছাড়া আরও কিছু বিশেষ বিবেচ্য বিষয় আমলে নিতে হবে। যেমন—

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বৈশ্বিক অর্থনীতির উত্থান-পতন বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে, যা দক্ষভাবে মোকাবিলা না করতে পারলে সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান

নয়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি।

সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ: অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির এ সংকট মোকাবিলায় সরকার একা করতে পারবে না। ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষ সবাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে সংকটের মুখোমুখি, তা অস্থায়ী। সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণের কঠোর পরিশ্রম এবং সরকারের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুখে-দুঃখে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি শুভ্রার

ঘুষ নেওয়ার সংবাদ প্রকাশ / সাংবাদিককে গালি দিয়ে ভূমি কর্মকর্তা ফেসবুক পোস্ট

কুয়াশা নিয়ে যে তথ্য জানাল আবহাওয়া অফিস

নির্ধারিত সময়ের আগে অফিসে প্রবেশ, নারী কর্মীকে চাকরিচ্যুত করল কোম্পানি

শহীদ শিহাবের কবর জিয়ারতে জেলা এনসিপির নতুন কমিটির নেতারা

২-৪টা আসনের জন্য কারও সঙ্গে জোট করব না : নুর

‘আমাকে সাসপেন্ড করেন’ বলতে থাকা চিকিৎসককে অব্যাহতি

বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার বিকল্প কেউ নেই : কায়কোবাদ

গণতন্ত্র উত্তরণে খালেদা জিয়ার বেঁচে থাকা জরুরি : অমিত

চিকিৎসায় অবিশ্বাস্য সাফল্য, ৩ দিনেই ক্যানসার থেকে সুস্থ হলেন নারী

১০

‘টাইম টু টাইম’ শাশুড়ির স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখছেন ডা. জুবাইদা

১১

বিএনপি সবসময়ই ‘পলিটিক্স অফ কমিটমেন্টে’ বিশ্বাসী : রিজভী

১২

বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হবে : গণশিক্ষা উপদেষ্টা

১৩

মির্জা আব্বাসের আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী ভিপি সাদিক কায়েম

১৪

‘দেশের অগ্রযাত্রায় প্রবাসী তরুণদের জ্ঞান-প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে যুক্ত করতে হবে’

১৫

বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক চায় ভারত : প্রণয় ভার্মা

১৬

চায়ের দোকানে বিমান হামলা, নিহত ১৮

১৭

ববি ছাত্রদলের নেতৃত্বে মোশাররফ-শান্ত-মিজান

১৮

ব্রিজ উদ্বোধনের আগেই প্যান্ডেল ভাঙচুর

১৯

কুলদীপ–প্রসিধের চার উইকেট, জয়সওয়ালের শতকে সিরিজ ভারতের

২০
X