ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থান এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়াজুড়েই আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মুক্ত বিশ্বে অভিনন্দিত হয়েছে মহিমান্বিত এ বিজয়। তবে এ বিজয়কে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা ছাত্র-জনতার বিজয় এবং পতিত স্বৈরাচারের দিক থেকে গণমানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানোর জন্য সহিংসতায় মেতে উঠেছে। বিনষ্ট করছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দলমতনির্বিশেষে সবার উদ্দেশে বলেছেন, সব ধরনের সহিংসতা থেকে দূরে থাকতে হবে। কোনো ভুলের জন্য অর্জিত বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে এরই মধ্যে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। যাদের দ্বিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করেছে গত পৌনে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসকরা। ছাত্র-জনতার একদফা আন্দোলনের বিজয়ে দেশবাসীর মতো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এখন থেকে আর তাদের কর্তৃত্ববাদের হুকুম তামিল করতে হবে না।
ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, বাজুস, আইসিসিবি এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আশা, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় অর্থনীতিকে সুস্থ ধারায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জাতীয় সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় প্রকাশ করেছে। ব্যবসায়ীদের আশাবাদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেহেতু একজন বিশ্বনন্দিত অর্থনীতিবিদ, সেহেতু অর্থনীতি পুনর্গঠনে তিনি সঠিক পথে এগোতে সক্ষম হবেন। বিশ্বজুড়ে তার যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি, তা দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান অস্থির অবস্থা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সমূহ ক্ষতি করেছে। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারকে বাণিজ্যবান্ধব ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে হতে হবে কঠোর।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আঘাত লাগে। দেখা দেয় নৈরাজ্য। বিভিন্ন এলাকায় হামলা, ভাঙচুর, সংঘাত, লুটপাট চলে। প্রধান সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানানো হলেও কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। ব্যক্তি বা দলগত শত্রুতায় হামলা চালানো হয়েছে। জেল ভেঙে পালিয়েছে কয়েদিরা। ডাকাতদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। লুটপাট হয়েছে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। অপরাধী চক্র হঠাৎই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে যেন ‘মগের মুল্লুক’ কায়েম করতে চেয়েছে। আত্মরক্ষার তাগিদেই এদের প্রতিরোধে সক্রিয় হয়েছেন সাধারণ জনতা। লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে এসে দল বেঁধে, রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন নিজেদের এলাকা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যখন নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছিল, তাদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে মন্দির-উপাসনালয় পাহারা দিয়েছেন ছাত্র-জনতা। যাদের মধ্যে মাদ্রাসার ছাত্ররাও আছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয় হিন্দু মহাজোট নেতা গণমাধ্যমকে জানান, তারা ভালো আছেন, তাদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কারা হামলা-ভাঙচুর, লুটতরাজ, ডাকাতি নৈরাজ্য চালিয়ে ছাত্র-জনতার বিজয়কে ম্লান করতে চাচ্ছে? তাতে কাদের লাভ? এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জাতির কঠিন ক্রান্তিকালে পুলিশ দায়িত্ব পালনে বিরত থাকায় তাদের অভাবটা পূরণ হয়নি। এ সুযোগটাই নিয়েছে অপরাধী চক্র এবং স্বার্থান্বেষী মহল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পুলিশের চেইন অব কমান্ড ঠিক করার নির্দেশ দিয়ে, তারা যেন সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সেনাপ্রধান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, যারা এসব অপরাধ করছে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। জরুরি নির্দেশনা দিয়ে নতুন আইজিপি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিতে বলেছেন। ছাত্র-জনতা সজাগ, সেনা টহল জারি রয়েছে, পুলিশ দায়িত্বে সক্রিয় হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব দ্রুতই সুশৃঙ্খলায় ফিরে আসবে বলে আশা করছে সবাই। এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
লেখক: রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের উপদেষ্টা