বিগত দেড় দশক অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে যে বিপুল পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, তার বিরাট অংশই হয়েছে ‘লুট’! শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি আর অনিয়মকে এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে যে, এগুলোকে ডাকাতি, লুটপাট বললে সত্যিকারই কম বলা হয়। এ খাতে বেশকিছু অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, উল্টো দায়মুক্তি আইন পাস করে বিচারের পথ রুদ্ধ করেছে সরকার, যা এখনো বহাল। ডাকাতির এ অবস্থাকে ‘মগের মুল্লুকে’র ভয়াবহতাকেও হার মানায়। কেননা তখন মগেরা পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে এসে আচমকা এই দস্যিপনা করত। আর তা থেকে দীর্ঘ সময় পর হলেও রেহাইও মিলেছে এ অঞ্চলের মানুষের। কিন্তু তাদের প্রেতাত্মা যেন রয়েই গেছে বিভিন্ন রূপে। কখনো দুর্নীতি, কখনো অসাধু ব্যবসায়ী; আবার স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেই এ দেশের শাসকশ্রেণি এমন পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে যে, তারা সব অপকর্মে আনুষ্ঠানিক বৈধতা দিতেও কার্পণ্য করেনি। অনৈতিক অবৈধ কাজের সুবিধার্থে ব্যবহার করেছেন রাষ্ট্রের আইন; তাতেও কাজ না হলে আইন তৈরি করে চরিতার্থ করেছেন সেই অনন্ত ভোগের অভিলাষ। এতে করে সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের জীবনই নানাভাবে হয়েছে দুর্বিষহ।
শনিবার দৈনিক কালবেলায় ‘বিদ্যুৎ খাতে ইচ্ছামতো লুট’ শীর্ষক শিরোনামে বিদ্যুৎ খাতের যে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা দীর্ঘ সময়ের দুঃশাসনেরই প্রতিচ্ছবি—এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে কোনো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এর বেশিরভাগই কোনো কাজে আসেনি। সরকারি হিসাবে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি। এমনকি দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত, তারও সঠিক কোনো হিসাব নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। সবার জন্য সরবরাহ নিশ্চিত না করে শুধু সংযোগ দিয়েই শতভাগ বিদ্যুতায়নের কৃতিত্ব জাহির করা হতো এতদিন। শুধু তা-ই নয়, গত তিন মেয়াদে এ খাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এ সময় শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই লুটপাট হয় ১ লাখ কোটি টাকা। এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া এ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ক্রয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও রক্ষণাবেক্ষণেও রয়েছে চরম অনিয়ম এবং লুটপাটের অভিযোগ। পাশাপাশি যোগ্যতা বিবেচনা না করে সরকারের পছন্দের লোকজনকে বসানো হয় এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে। বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সব কেন্দ্রেই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনে অনুমোদন দেওয়া হয়। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একই কেন্দ্র একাধিকবার সরকারের কাছে বিক্রির ঘটনাও রয়েছে। এমনকি লুটপাটের অংশ হিসেবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে টাকার পরিবর্তে পেমেন্ট দেওয়া হয় ডলারে, যার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের পুরো ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি, অনিয়মের মতো ক্যান্সার এমনভাবে বাসা বেঁধেছে, যার মূলোৎপাটন অনিবার্য। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সেই স্বপ্ন জেগেছে মানুষের মধ্যে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কাজ শুরু করেছে। আমরা চাই, পুরো ব্যবস্থায় তো বটেই; বিদ্যুৎ খাতে বিরাজমান দৈন্যদশা দূরীকরণসহ বিগত সব দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতিমুক্ত দেশের স্বপ্নপূরণ হোক।