আহসান হাবীব
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০২:৩৪ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ড. ইউনূসকে সময় দিতে হবে

ড. ইউনূসকে সময় দিতে হবে

বাংলাদেশ আমার-আপনার প্রিয় দেশ। আমাদের গর্বের, অহংকারের এ প্রিয় দেশটি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উপলক্ষ গত ৫০ বছরে খুব বেশি পায়নি। আমরা যখন দেশের বাইরে যাই, ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় শুধু বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও পরিচয়ের কারণে অনেক হেনস্তার মুখোমুখি হই। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন যাই, ওই দেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা অনেকে দেখবেন মানুষ হিসেবে আমাদের ন্যূনতম সম্মানটুকুও দেখায় না, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় হয়রানি করে। সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যতিক্রম। লিওনেল মেসিও আমাদের ইউনূসের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করে। আমাদের ইউনূসকে পৃথিবীর ১০টি প্রভাবশালী দেশ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিয়েছে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬১টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। তিনি কত কত পুরস্কার, সম্মাননা পেয়েছেন, তার বর্ণনা করতে গেলে বড় আকারের কয়েকটা বই হয়ে যাবে। ড. ইউনূসের তত্ত্ব ও অবদান নিয়ে বর্ণনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, তার জন্য ভিন্ন একটি লেখার পরিকল্পনা রয়েছে। এ লেখায় শুধু এটুকু বলি, তার ‘ক্ষুদ্রঋণ’ মডেল বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো না কোনোভাবে পড়ানো হয়। তার উদ্ভাবিত ‘সোশ্যাল বিজনেস’ মডেল কেন্দ্র করে বিশ্বের অন্তত ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ বা একাডেমিক কার্যক্রম রয়েছে।

নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূসের কাছে আমরা কোন বাংলাদেশকে এবং কোন সময়ে তুলে দিলাম? যে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে হওয়া বৈষম্য দূরীকরণেরে দাবিতে শিক্ষার্থীদের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জাতিসংঘের হিসেবে ৬৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, বেসরকারি হিসাবে যে সংখ্যা দুই হাজারের অধিক। আহত, পঙ্গু ও অন্ধ করা হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে। যে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন, সেই কোটায় নিয়োগ কীভাবে হয় ও তার পরিণতি কী হয়, তার একটা উদাহরণ দিই। এ আন্দোলন দমনে শিক্ষার্থীদের রাতের অন্ধকারে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম করা ও অমানবিক নির্যাতন করার সবচেয়ে বড় অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি ‘ডিবি হারুন’ নামে পরিচিত। তার বাবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় আসেন ১৯৯৬ সালের পর। ১৬ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবারের প্রথম সারির অনেক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তার বাবা একজন ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’। তিনি দলীয় বিবেচনায় ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ কোটায় পুলিশে চাকরি পান। শুধু এ আন্দোলনেই নয়, চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সরকারের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণে তিনি প্রতিপক্ষকে দমন-নিপীড়ন করে আসছেন।

আমরা এমন একটা বাংলাদেশকে আমাদের হিরো মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তুলে দিলাম, যেখানে শুধু সর্বশেষ সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে আত্মসাৎ হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ২০০৯ সালে ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। শুধু এ সময়ে সরকার ঋণ করেছে সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। যার উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের ছত্রছায়ায় বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

আমরা এমন একটা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাচ্ছি, যেখানে শুধু গত ১৫ বছরে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। এ সময়ে গুম হন ৬৭৭ জন, কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৪৮ জন। হামলা-মামলার সংখ্যা অগণিত।

এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারদলীয় ক্যাডারদের অস্ত্রাগারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করে একশ্রেণির দলবাজ শিক্ষক তৈরি হয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে গিয়েছিল মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে এক বিভীষিকার নাম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গিনিপিগ বানিয়ে পরীক্ষণের নাম করে বারবার শিক্ষা পদ্ধতির অপরিকল্পিত পরিবর্তন করে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনে দেশ গড়ার প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সচিবালয়কে চাটুকারিতা প্রদর্শনের রঙ্গমঞ্চে রূপান্তরিত করা হয়েছে। প্রশাসনের প্রত্যেকটি স্তরে ঘুষ-দুর্নীতিকে ‘স্বাভাবিক’ করে ফেলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো ধরনের তদবির বা ঘুষ ছাড়া রাজউক থেকে বাসা তৈরির নকশার অনুমোদন পেয়েছেন, এমন এক শতাংশ মানুষও পাওয়া যাবে না। দুর্নীতি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার আবদুল মালেক, পিএসসির ড্রাইভার আবেদ আলীরা শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের ওস্তাদদের টাকার হিসাব সামনে এলে শতকোটি টাকার দুর্নীতিকে বরং ‘মানবিক দুর্নীতি’ মনে হবে। যার বড় প্রমাণ সাবেক পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, এনবিআর কর্মকর্তা, ডিএমপি কমিশনার, ডিবিপ্রধান, কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের ব্যক্তিগত সম্পদের ফাঁস হওয়া ‘আমলনামা’।

এভাবে খাত ধরে ধরে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দলবাজি, জুলুম, নির্যাতন, গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি প্রভৃতির হিসাব কষে শেষ করা যাবে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এটা যারা করেছে, আমাদের এ দেশের প্রতি ন্যূনতম করুণাও তারা দেখায়নি। আজকের বাংলাদেশ নামের ধ্বংসস্তূপের পেছনে অত্যন্ত নির্মম ও জঘন্য এক প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করেছে। কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে একটা দেশ ও জাতিকে এতটা নিষ্ঠুরভাবে শেষ করা যায় না।

আমরা প্রত্যেকেই জানি, এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্যের বীজ বপন করে দেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল সবক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গ্রুপকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দানবে পরিণত করা। যেন ওই দানবরা সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোতে জুলুমের রাজ তৈরি করতে পারে। এভাবে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ধাপে ধাপে বহুস্তরিত জুলুমের পিরামিড তৈরি করা হয়েছে। যে জুলুম পিরামিডের চূড়ায় আরোহণ করত এক ‘ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ’, এক ‘প্যাথলজিক্যাল স্যাডিস্ট’।

আমাদেশের বস্তুগত, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতির পাশাপাশি, সমাজকে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রতি পদে পদে অবিশ্বাস। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাকে ধ্বংস করে দিয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক এমন এক সমাজ তৈরি করা, ‘আস্থাহীনতা’ যার ভিত্তি। ক্ষমতার লেজুড়ে পা রাখার উদ্দেশ্যে কত আপনজন, প্রতিবেশী, বন্ধু একে অন্যের শত্রু হয়েছে, তা হিসাব করেও বলা যাবে না। শুধু ফ্যাসিবাদী আনুকূল্য পাওয়ার জন্য বহু নিরপরাধ ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের মানুষকে ‘জঙ্গি’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী, ‘রাজাকার’ সাব্যস্ত করে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন একটা সমাজে আমরা আছি, সামগ্রিকভাবে যেখানে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ ভালো নেই।

আমরা শুধু ভালো ছিলাম না, তা নয়। আমরা এই জুলুমের রাজকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়ে সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এ দেশ থেকে পলায়ন করছিলাম। যারা দেশ ছাড়তে পারছিলাম না, তারা প্রকৃতির সর্বোচ্চ অভিযোজনশীল ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নিজেকে কোনোভাবেই মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে শিখে গিয়েছিলাম। এমন অবস্থায় যখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, সেখান থেকে ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরে সংগঠিত সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা আবার আশাবাদী হতে লাগলাম। এই আশা-ভরসার যোগ্য সারথি হিসেবে আবির্ভূত হলেন নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূস। আমি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী যতজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা প্রায় সবাই এ সময়ের জন্য ড. ইউনূসকে সবচেয়ে যোগ্য মনে করেছেন। দেশে ও দেশের বাইরে সমানভাবে সমাদৃত ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা তাকে ও তার সরকারকে বিতর্কিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে তাদের সব উইং চালু করে অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষকে এ সত্যটা বুঝতে হবে, আমরা চাইলেও মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না। সব পর্যায়ের জুলুম, অবিচার, দুর্নীতি, অনাচার, বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও প্রকৃতিবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় দরকার কাঠামোগত সংস্কার। প্রয়োজনীয় এ সংস্কারের জন্য বর্তমান সরকারকে সময় না দিলে আমাদের চারপাশে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসর ও আয়নাঘরের জনক-জননীরা আবার আমাদের জাহিলিয়াতের যুগে ফেরত নিয়ে যাবে।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শাপলা চত্বর গণহত্যার বিচারে আলাদা কমিশন গঠনের দাবি

‘১৭ বছরে ব্যবসা ছেড়ে ভারতে গেছেন অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী’ 

ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ গোপালগঞ্জ : নুরুল হক 

ঐকমত্য কমিশনে মতামত দিয়েছে ২৩ দল

আন্ডারটেকার ও মাইক টাইসন আসছেন ‘বিগ বস ১৯’-এ!

চিলিতে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

সাবেক প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহে গ্রেপ্তার

রাতে যেসব জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড় ও বজ্রবৃষ্টির আভাস

সাফে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

১০

পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৮৮০

১১

চীন সফরে নাহিদের সঙ্গে যাচ্ছেন যারা

১২

ব্যালট বাক্সের হিসাব চেয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের ইসির নির্দেশ

১৩

এক দশক পর কারামুক্ত ব্লগার ফারাবী

১৪

১০ মাসেও মেলেনি মোস্তাফিজ হত্যার রহস্য, থামছে না মায়ের কান্না

১৫

নিজের যেসব বদঅভ্যাসে লিভারের ক্ষতি করছেন না জেনেই

১৬

জুলাই সনদ নিয়ে মতামত জমা দিয়েছে এনসিপি

১৭

‘দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে গাজায়, হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল

১৮

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন দেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি : এ্যানি

১৯

৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত, সরকারের ব্যয় হবে কত

২০
X