ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ছাত্র-জনতার অনুরোধে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য নিরন্তর কাজে করে যাচ্ছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোববার সন্ধ্যায় তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এটা ছিল তার প্রথম ভাষণ। ভাষণে তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এই লক্ষ্যে তিনি সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় তিনি ফ্যাসিবাদী হাসিনার সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ফ্যাসিস্ট সরকার কীভাবে শেষ করেছে। যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজার খাতে লুটপাট, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করাতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন ও বঞ্চনা এবং বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে।’
তিনি জানিয়েছেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর বর্তমান সরকার এমন একটি দেশ গড়তে চায় যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার পুরোপুরি সুরক্ষিত। সরকারের লক্ষ্য একটিই—উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। দ্বিধাবিভক্ত জাতিতে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে এটি পরিবারে পরিণত করা।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্যপ্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কর্মযাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে দেশবাসীর কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছেন সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা অনুধাবন করছি যে, আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে; কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ আমরা প্রস্তুত।’
মুক্তিযুদ্ধেরও লক্ষ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলাম, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বজাধারীরা এই পথে না গিয়ে উল্টো ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে। দেশটাকে সর্বগ্রাসী লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে। আয়নাঘরের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নিকৃষ্ট নজির সৃষ্টি করে। এরই প্রতিবাদে জেগে ওঠে ছাত্র-জনতা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ। এই সুযোগ যেন বিনষ্ট না হয় এ ব্যাপারে আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।