ড. সেলিম জাহান
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৯ এএম
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উত্তরবঙ্গের নতুন বন্যায় করণীয়

উত্তরবঙ্গের নতুন বন্যায় করণীয়

আবারও বন্যা, আবারও ভয়াবহ দুর্যোগ। কিছুদিন আগে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের, বিশেষত ফেনী-সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা সম্পূর্ণভাবে সামাল দেওয়ার আগেই আবার নতুন বন্যার আঘাত এসেছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। তিস্তা, করতোয়া, আত্রাই, যমুনা এবং উত্তরবঙ্গের আরও একাধিক নদীর প্লাবন এবং সেইসঙ্গে সে অঞ্চলের অবিরাম বর্ষণের ফলে বন্যা এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে পুরো উত্তরবঙ্গে। অল্প সময়ের মধ্যেই একাধিক জেলা, জনপদ এবং লোকালয়ের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে। সেসব অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ আজ পানিবন্দি। উত্তাল নদীগুলোর উন্মত্ত প্রবাহে ভেসে গেছে মানুষের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ। সে অঞ্চলের আমন ধান, শাকসবজিসহ নানান ফসল বিনষ্ট হয়েছে। রেলপথ ডুবে গেছে, পথঘাট ভেঙে গিয়ে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত। স্বল্পমেয়াদি বন্যার সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদীভাঙনের আশঙ্কা। খোলা আকাশের নিচে দিনপাত করছে অসহায় মানুষ। চারদিকে একটিমাত্র আর্ত হাহাকার ধ্বনি—‘আমরা ডুবছি, আমাদের বাঁচাও।’

বন্যার্ত জেলাগুলোর অসহায়ত্ব নিয়ে কাতর আমরা সবাই। যদিও বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে, তবু বন্যা-উদ্ভূত অবস্থায় মানুষের কষ্ট, তার অসহায়ত্ব আর আর্তিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। বন্যার ফলে সংকট দেখা দিচ্ছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, বস্ত্র ও আশ্রয়ের। আজ সারা দেশের বার্তা একটাই—‘মানুষ বাঁচান’। এ মুহূর্তে আমরা যে যেখানে আছি, যে যেভাবে পারি, আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে মানবতার এই ডাকে—এটা দয়াদাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়, এটা নৈতিকতার ব্যাপার, সামাজিক ন্যায়বিচারের ব্যাপার এবং আমাদের বর্ধিত ও প্রলম্বিত স্বার্থরক্ষার ব্যাপারও বটে। আমরা অর্থের স্বল্পতার দোহাই দিতে পারি না, আমরা নির্বিকারত্বের ঢালে মুখ লুকোতে পারি না, আমরা আমাদের বিত্তের উলঙ্গ প্রকাশও করতে পারি না। কারণ চূড়ান্ত বিচারে, ‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না’।

এ মুহূর্তে করণীয় তিনটিই। প্রথমত, জরুরি ভিত্তিতে মানুষের জীবন রক্ষা করা। সে কাজটি অতি দ্রুত দুটো পর্যায়ে করতে হবে—এক. মানুষদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর। বন্যায় আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকেই এগিয়ে এসেছে উপকরণ ও জনবল নিয়ে। দুই. বন্যাকবলিতদের খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানীয়, বস্ত্র আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক জিনিসের ব্যবস্থা করা। অনতিবিলম্বে তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। মনে রাখা দরকার, সেসব জিনিসই তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যেগুলো অনতিবিলম্বে তাদের লাগবে, যেগুলো প্রক্রিয়াকরণ ভিন্নই তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, বন্যার ত্রাণ হিসেবে বন্যার্তদের এমনসব সামগ্রী দেওয়া হয়েছে যেগুলো তারা সে মুহূর্তে ব্যবহার করতে পারছে না। যেমন—প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে শুকনো খাদ্যসামগ্রী তাদের এখন দরকার। বিশুদ্ধ পানির চেয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট তাদের বেশি প্রয়োজন।

ত্রাণকাজের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে, দরকার আছে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণকাজের মধ্যে সমন্বয়ের। বেসরকারি খাতের সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরি। নানান সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে যে, কিছুদিন আগের ফেনী-সিলেটের বন্যার জন্য যে বিপুল অঙ্কের অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী, তার একটি বিরাট অংশ এখনো অব্যবহৃত রয়েছে। সেগুলোকে উত্তরবঙ্গের ত্রাণকার্যের জন্য কি ব্যবহার করা যায় না?

দ্বিতীয়ত, বন্যার পানি নেমে গেলে মধ্যমেয়াদে তিনটি জিনিস প্রকট হয়ে দেখা দেবে। প্রথমত অভাব, সবকিছুর খাদ্যের, কর্মের, আয়ের। বুভুক্ষা সেখানে জায়গা করে নেবে। এখন থেকেই সে ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খোলা বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে জরুরি খাদ্যসামগ্রী তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যেহেতু বন্যার ফলে আগাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সময়মতো কৃষকদের কাছে কৃষির নানান উপকরণ—বীজ, সার কী করে পৌঁছানো যায়, তার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন।

জরুরি ভিত্তিতে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কিংবা গ্রামের নানান পুনর্গঠন নির্মাণকাজ, যেমন রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের মাধ্যমেও কর্মনিয়োজন বাড়ানো যেতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে একদিকে যেমন কাজের সৃষ্টি হবে, তেমনি গ্রামের রাস্তাঘাটও একটি শক্ত ভূমির ওপর দাঁড়াতে পারবে। বন্যার পরপরই নানান পানিবাহিত এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য রোগের প্রকোপ দেখা দেবে। বর্তমান সময়ে দেশে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বন্যাকবলিত অঞ্চলে আরও সংকটময় হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে দুস্থ মানুষদের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা-সুবিধালভ্য করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে শিশুদের প্রতি। বন্যা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে পরে গ্রাম থেকে নিরন্ন উদ্বাস্তু মানুষের শহরে অভিবাসন ঘটতে পারে। সে অবস্থায় এসব শরণার্থীর নানান চাহিদা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। বেশিরভাগ নিরন্ন মানুষই আসবে কাজের খোঁজে। সেই কর্ম-সুযোগ শহুরে অর্থনীতিতে কী করে তৈরি করা সম্ভব, সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা দরকার।

তৃতীয়ত, বন্যা মোকাবিলার সমাধান চাইতে হবে দীর্ঘমেয়াদেও। সন্দেহ নেই, আমাদের দেশের বন্যার একটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রেক্ষিত আছে। সেদিকটায় নজর ফেরাতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই। চিন্তায় রাখা দরকার যে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনাই কি যথেষ্ট, নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে বহুপক্ষীয় পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে? শেষ বিষয়টি বর্তমান সময়ে বিশেষ বিবেচনার দাবিদার। ঠিক এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের বন্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালও বন্যাকবলিত। তাদের বন্যার কারণ এবং প্রভাব আমাদেরই মতো। সুতরাং এই বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের জন্য আঞ্চলিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

বন্যা মোকাবিলার জন্য একটা অর্থভান্ডার এরই মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরও অর্থায়ন, দেশি, বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে এর আরও বিস্তৃতি কি সম্ভব নয়? সেইসঙ্গে প্রয়োজন এর একটি আনুষ্ঠানিক স্থায়িত্বের। যেহেতু আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বন্যা উপর্যুপরিভাবে ঘটবে, সেজন্য বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবার অবকাশ আছে।

আমি পানি-বিশেষজ্ঞ নই, বন্যাবিশারদও নই। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানে কয়টা জিনিস বুঝতে পারি। এক, বাংলাদেশে বন্যা স্মরণাতীতকাল ধরে হয়ে এসেছে এবং এ দেশে বন্যার আপাতন অনেকটা অর্থনীতির বাণিজ্য চক্রের মতোই কাজ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে বেশ কয়েক বছর (ধরা যাক ৫-৭ বছর) ছোট ছোট বন্যার পর একটা বড় বন্যা হয়েছে, মানে একনাগাড়ে অনেক ছোট বন্যার পর বড় একটা। ছোট বন্যাগুলো তাদের বুকে ধরে পলিমাটি নিয়ে এসেছে, যা আমাদের ভূমিকে করেছে উর্বর। তাই একটি বড় বন্যার ক্ষতিকে যখন তার পূর্ববর্তী ৫-৭টি ছোট বন্যার পলি এবং তা থেকে উৎসারিত ফসলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তখন নিট ক্ষতি কিন্তু ততবেশি হয়। বলাবাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ চিত্রটি কিন্তু বদলে গেছে।

দুই, বড় বন্যাগুলো যখন ৫-৭ বছর পর এসেছে, তখন ১২ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাই আমরা তাকে বলেছি বান। কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকেনি পানি। ক্ষতি হয়েছে জনপদের, সম্পদের, মানুষের জীবনে। কিন্তু বানের পানি নেমে গেছে অতি দ্রুত। সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। বন্যার পানি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘদিন।

তিন, আমাদের নদীকাঠামোর নাব্য উত্তর থেকে দক্ষিণে। জলধারা ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। কিন্তু বহু বছর ধরে ভৌত অবকাঠামো বাঁধ, সড়ক নির্মিত হয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে। ফলে জলধারার বা বন্যার স্বাভাবিক গতিধারা বিঘ্নিত হয়েছে এবং এর ফলে বন্যার পানি দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা। এতে মানুষের ভোগান্তির কাল এবং গভীরতা দুটোই বেড়েছে। শহরাঞ্চলের জলাশয়, পুকুর এগুলো বুজিয়ে হর্ম্যরাজি উঠেছে ঠিকই। কিন্তু বিঘ্নিত হয়েছে পানির স্বাভাবিক চলাচল। সামান্য বৃষ্টিতেই তাই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া বন্যার তাণ্ডবকে রোখা যাবে না আমাদের দেশে। সব সমস্যার মতো বন্যারও একটি উপশমের দিক আছে, আবার একটি নিবারণেরও দিক আছে। এ মুহূর্তে উপশমটাই জরুরি, কারণ ‘মানুষকে বাঁচাতে হবে’ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নিবারণটি অত্যাবশ্যকীয়; কারণ ‘মানবতাকে বাঁচাতে হবে’। দুটোর জন্য আবেগও লাগবে, বিবেকও লাগবে।

লেখক: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আসলেই কি পিসিবির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন পাইক্রফট?

কুমিল্লায় ফের বাড়ছে স্ক্যাবিসের সংক্রমণ

গার্দিওলার চোখে ইতিহাসের সেরা কোচ কে?

সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের শিল্প গ্রুপের দুই কর্মকর্তা গ্রেপ্তার 

আজ প্রথম প্রেম মনে করার দিন

এবার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পিটিশনে সই করল হাজারো ইসরায়েলি

কীভাবে বুঝবেন ডেঙ্গু নাকি চিকুনগুনিয়া হয়েছে

চাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণা

নিখোঁজের এক মাস পর শ্বশুরবাড়ির সেপটিক ট্যাংকে মিলল জামাইয়ের লাশ

শিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ১

১০

টানা ৫ দিন বৃষ্টি ঝরতে পারে যেসব অঞ্চলে

১১

বাকৃবিতে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি বাস সার্ভিস

১২

কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ জারির দাবিতে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি

১৩

বিয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছুটে এসে খুন হলেন নারী 

১৪

পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে প্রতিক্রিয়া জানাল ভারত

১৫

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

১৬

মেন্টরস' স্টাডি অ্যাব্রোডের আয়োজনে ‘স্টাডি ইন দ্য ইউকে অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড ওপেন ডে’

১৭

পাকা চুল বা দাড়ি তুলে ফেলা কি জায়েজ?

১৮

শেখ হাসিনাসহ দায়ীদের কঠোর শাস্তি চাইলেন নাহিদ

১৯

পূর্বপুরুষের হস্তান্তর করা জমি দাবি করে আরেক জমি দখলচেষ্টার অভিযোগ

২০
X