টানা ১৫ বছর একটা অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে একই ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকার ফলে ইতিহাসের অমোঘ সত্য প্রমাণ করে, সেই প্রাচীন রাজনৈতিক দলের সরকারও একনায়কতান্ত্রিক সরকারে পরিণত হয়। স্বভাবতই তাকে পরিণতি ভোগ করতে হয়। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সাল থেকে অদ্যাবধি যেসব ব্যক্তি সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন, তারা সবাই ট্র্যাজিক হিরোর মতো করুণ পরিণতি বরণ করে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন বিতর্ক রয়েছে। নানাজনের নানা মত রয়েছে। প্রকৃত সত্য যাই হোক, পতন হয়েছে অস্বাভাবিক পদ্ধতি বা পরিস্থিতিতে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সরকারপ্রধানের দেশত্যাগ, সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের পলায়ন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ বিলুপ্ত করা হলে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। স্বাভাবিক কারণেই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলা নৈরাজ্য এবং বৈষম্যের শিকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সাময়িক পুলকিত হয়। তাদের দীর্ঘদিনের চাহিদা উপস্থাপন করার স্বাধীনতা পায়। সে কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের বৈষম্যের বিবরণ সরকারের কাছে তুলে ধরেন। বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটা বিশাল চাপ তৈরি করে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে এ পর্যন্ত আটটি পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর পে-স্কেল ঘোষণার কথা থাকলেও রাজনৈতিক বৈরী পরিস্থিতির কারণে তৃতীয় ও ষষ্ঠ পে-স্কেল ঘোষণায় সর্বাধিক আট বছর সময় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর ৯ বছর অতিবাহিত হলেও স্থায়ী পে-কমিশন গঠন কিংবা আগের ধারাবাহিকতা অনুসারে পাঁচ বছর পরপর পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়নি। সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি বিগত সরকারের শাসনামলে অধিক চর্চা করা হয়েছে, তা হচ্ছে পদ না থাকলেও সুপারনিউমারারি পদ তৈরি করে লাগামহীন পদোন্নতি প্রদান। সরকার এগুলো করেছে শুধু বিশেষ কিছু ক্যাডার পদে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য। নির্ধারিত সময়ে পে-স্কেল ঘোষণা না করলেও বিশেষ কিছু ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য সুবিধাদি বৃদ্ধিতে কোনো সমস্যা হয়নি। একটা বিশেষ গোষ্ঠীকে গাড়ি ক্রয়ের নামে বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা লোন প্রদান করে আবার রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা বেতনের সঙ্গে যোগ করে দেওয়ার বৈষম্য স্থায়ীকরণ পদ্ধতি কিন্তু ঠিকই বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্যদিকে, সিলেকশন গ্রেডসহ অন্যান্য সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে অর্থ সাশ্রয়ের নামে সুবিধাবঞ্চিত কর্মচারীদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। এসব করে সরকারের পক্ষে একটি অনুগত দলীয় প্রশাসন তৈরি করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। অন্যদিকে, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তোষামোদ থেকে শুরু করে তদবির—সবকিছুতেই এতটা ব্যস্ত ছিলেন যে, নিচের দিকের কর্মচারীদের জন্য চিন্তা করা তো দূরের কথা, তাদের নায্য দাবি-দাওয়াকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অন্তরায় ভেবে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আওয়ামী সরকারের আমলেও ২০২১ সাল থেকে বারবার পে-স্কেলের দাবি তোলা হলে সে দাবির প্রতি কর্তৃপক্ষের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না; বরং বেসিকের ৫ শতাংশ অতিরিক্ত বোনাস দিয়ে তাদের ভাবখানা এমন ছিল যে, অনেক কিছু উদ্ধার করে ফেলেছিলেন।
দিনে দিনে দেশের বাজেট বড় হচ্ছে, কাজের পরিধি বাড়ছে, সংগত কারণেই সব দপ্তর পুনর্গঠন করে পদ সৃজন করা সমীচীন ছিল। কিন্তু পদ সৃজন না করে শুধু বিশেষ কিছু ক্যাডার পদে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি প্রদান করে একটিমাত্র মোটা প্রশাসন তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন পদে যারা বছরের পর বছর চাকরি করছেন, তাদের পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে এক প্রকার উন্নাসিকতা দেখানো হয়েছে। সব দপ্তরের কাজের পরিধি অনুসারে নতুন নতুন পদ সৃজন করা হলে সব স্তরে একটা ভারসাম্য বজায় থাকার পাশাপাশি নিম্ন পদে কর্মরত কর্মচারীদের পদোন্নতির বিষয়টিও ত্বরান্বিত হতো। বেতন বৃদ্ধির হার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়া, যথাসময়ে পদোন্নতি না হওয়া এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটা স্বৈরাচারী মনোভাব সব সরকারি দপ্তরে ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের সঙ্গে শুধু বৈষম্য নয়, একপ্রকার মানসিক অত্যাচার হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে। যার ফলে এসব গ্রেডের কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা এবং সৃজনশীলতার বিকাশের পরিবর্তে নিজেকে টিকিয়ে রাখার বা নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় বেশি মনোযোগী করেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মূল লক্ষ্য একটা শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যদি আমরা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হই, তবে কবে আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাব? প্রকৃতির ইচ্ছায় আমরা যে সুযোগ পেয়েছি তার সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ সবার কাম্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
অনেকে নানাভাবে বিষয়টি চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, এই দুর্বল ভিতের জনবল কাঠামোকে দ্রুত সংশোধন করে দ্রুততম সময়ে প্রতিটি দপ্তরে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করে সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন করতে হবে। এতে করে প্রতিটি দপ্তরে পদোন্নতিবঞ্চিত নিম্ন পদের অনেক কর্মচারী তাদের কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি পাবেন এবং একটা ভারসাম্যপূর্ণ প্রশাসন তৈরি হবে। প্রতি পাঁচ বছরে কমপক্ষে একবার পে-স্কেল ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিটি দপ্তর/সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো নিয়মিত সংস্কার করার একটা বিধান চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নবম পে-স্কেল ঘোষণা হতে পারে এই সমস্যার প্রাথমিক সহজতর সমাধান। অষ্টম পে-স্কেলে প্রথম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডের বেতন পার্থক্য হচ্ছে প্রায় ১০ গুণ। এই ব্যবধান কমিয়ে আনা প্রয়োজন। বৈষম্যমূলক ২০টি বেতন গ্রেড প্রণয়নের যুক্তি কী? বিদ্যমান ২০টি বেতন গ্রেড কমিয়ে ১০ থেকে ১২টি যৌক্তিক গ্রেডে নির্ধারণ করা যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন গ্রেডে চাকরি করলেও কর্মস্থলে ১১ থেকে ১৬তম গ্রেডের বেশিরভাগ কর্মচারীর প্রায় একই কাজ করতে হয়। অথচ কর্মক্ষেত্রে বেতন গ্রেডের ভিন্নতার কারণে যেমন আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তেমনি নিয়োগ বিধির জটিলতার কারণে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা তৈরি হয়। অথচ এসব গ্রেডে নিয়োগ যোগ্যতা প্রায় সমান। এ ছাড়া অনেক দক্ষ জনবল এসব গ্রেডে চাকরি করছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি সুনির্দিষ্ট জনবল কাঠামো থাকে। এই জনবল কাঠামোগুলোর মধ্যে পিরামিড আকৃতির জনবল কাঠামো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সরকারি দপ্তরে বিদ্যমান মাথামোটা সিলিন্ডার আকৃতির জনবল, প্রতিষ্ঠানের ভিত দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই দ্রুত মাথামোটা জনবল সংস্কার করে পিরামিড আকৃতির জনবল কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। সব স্তরের কর্মচারীদের জন্য অভ্যন্তরীণ ও মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে দক্ষ জনবল তৈরি করা হলেই দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন সম্ভব। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে যথাসময়ে পদোন্নতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বৈষম্যহীন নবম পে-স্কেল ঘোষণার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে নতুন পদ সৃজন করে একটা পরিকল্পিত জনবল কাঠামো গঠনই হতে পারে বিদ্যমান বেতন-বৈষম্য আন্দোলনের বিপরীতে একমাত্র সমাধান। নতুবা নির্দিষ্ট কোনো একটি গ্রুপের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হলে অন্য একটি গ্রুপ তাদের দাবি নিয়ে মাঠে আসবে। আবার যৌক্তিক দাবি অগ্রাহ্য করলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
ই-মেইল: [email protected]