জিয়াউর রহমান ছিলেন ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ থেকে ৩০ মে ১৯৮১ মেয়াদকালের দখলদার রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তি। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার অধিকার কে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছো, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও’ (অনূদিত)। এভাবেই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতের পরে পাকিস্তান দখলদার হানাদার বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে প্রদত্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ওই ঘোষণা মুহূর্তেই বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। শুরু হয় সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রাম। অবশেষে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ পনেরো খণ্ডের সিরিজ গ্রন্থের ২০০৪ সালের পুনর্মুদ্রণকৃত তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন’ মর্মে বর্ণনা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থ সিরিজের ২০০৪ সালের ওই পুনর্মুদ্রণটির তৃতীয় খণ্ড বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক এম এ সালাম।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই রিট মোকদ্দমাটি শুনানি অন্তে ২১ জুন ২০০৯ তারিখের এক রায়ে ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা’ শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধান পরিপন্থি মর্মে ঘোষণা করেন; এবং উপরোক্ত খণ্ডটি বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায় সব কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তির জন্য অবশ্যই পালনীয় এবং বাধ্যকর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে তিনি প্রথম পরিচিতি পান। স্বাধীন বাংলা বেতারের বেতারকর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি এই ঘোষণা পাঠ করেন। তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ হঠাৎ করেই মানুষ শুনতে পায় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে প্রথম কোনো সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ও ব্রিগেড কমান্ডারদের একজন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টরে তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ জুন প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের প্রথম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে ‘জেড ফোর্স’ সংগঠিত হলে তিনি এর নেতৃত্ব দেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেনাবাহিনীর ‘ডেপুটি চিফ অব স্টাফ’ নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭২ সালে তিনি ‘কর্নেল’, ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ‘ব্রিগেডিয়ার’ এবং একই বছরের শেষদিকে ‘মেজর জেনারেল’ পদে পদোন্নতি পান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও পরবর্তীকালে তার উদ্যোগেই স্বাধীনতাবিরোধীরা বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়। এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি আগে থেকে তার জানা থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের প্রতিহত করা বা রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি অবহিত করার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেননি। তার অধীন বাহিনীকেও বঙ্গবন্ধুর সম্ভাব্য খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি। বরং, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সবচাইতে বেশি সুবিধাভোগীদের তিনি অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৯ দিন পর তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ওই বছরের ৩ নভেম্বর কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্বে আসেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থান তাকে সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ক্ষমতায় আসার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের খুনিদের সেনাবাহিনীতে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পদোন্নতিও দেন। এমনকি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে ও কূটনৈতিক মিশনে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের চাকরির ব্যবস্থা করেন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন, তা সম্ভবত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় ১৯৭৬ সালে বিলাতের আইটিভি চ্যানেলের World in Action প্রোগ্রামে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেওয়া লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এই সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশীদ দাবি করে, বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে ১৫ আগস্টের বহু পূর্বেই জিয়াকে তারা অবহিত করে। ফারুক জানায়, ‘২০ শে মার্চ ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭: ৩০ মিনিটের দিকে সে জিয়ার বাসায় জিয়ার সাথে দেখা করে এবং তাকে বলে—The country required a change.’
উত্তরে জিয়া বলেন, ‘Yes, yes, lets go outside and talk’। তখন জিয়া ফারুককে নিয়ে বাইরে বাড়ির লনে যায়। সেখানে ফারুক পুনরায় বলে, ‘We have to have a change. We, the junior officers, have alreadz worked it out. We want your support and leadership’। জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। জিয়া বলেন, ‘If you want to do something, you junior officers should do it yourself’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh—A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)
প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৬ সালে দেওয়া জিয়ার মাসকারেনহাসকেই দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে। মাসকারেনহাসের ভাষায়, ‘In July, 1976, while doing a TV programme in London on the killing of Sheikh Mujib I confronted Zia with what Farook had said’ (তাদের সাক্ষাৎকারে)। জিয়া এ ব্যাপারে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সঙ্গে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টি এসেছে এভাবে—‘Zia did not deny it—nor did he confirm it’ (Anthony Mascarenhas, Bangladesh—A Legacy of Blood, page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986)।
সাক্ষাৎকারে জেনারেল জিয়ার গড়িমসি বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ভাব দেখে ধারণা করা যেতে পারে যে, ফারুকের সঙ্গে জিয়ার এ কথোপকথন সত্য। এর সত্যতার আরও প্রমাণ মেলে আরও অনেক বছর পরে ১৯৯৭ সালে, যখন ফারুক জেলে আর রশীদ ইউরোপে। ১৯৯৭ সালে রশীদের সঙ্গে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে। লিফশুলজের ভাষায়, ‘In 1997 I met Rashid for several hours in an European city, I ewnt over iwth him exactly hwat he had told Mascarenhas about Zia’s involvement. Rashid confirmed to me the accuracy of his interviwe with Mascarenhas’।
শুধু তাই নয়, রশীদ লিফশুলজকে এ ব্যাপারে আরও বহু কিছু বিস্তারিত জানায়। রশীদ জোরালোভাবে বলে যে, ‘He (Rashid) had met General Zia numerous times prior to the coup and that Zia was fully in the picture (In Conversation with Lawrence Lifschulty—The Daily Star, December 4, 2014).
জিয়ার সঙ্গে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে আরও অনেকবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, ‘একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়। জিয়া আরও বলে—If it is a success then come to me. If it is a failure then do not involve me.’ (আসাদুজ্জামান বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০১৮)। [ দ্বিতীয় কিস্তি আগামী রোববার ]
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন