দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। আমরা সাধারণত দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কথা শুনে অভ্যস্ত। এর বাইরেও যে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এ চক্রের প্রভাববলয় অত্যন্ত জোরালো, সে সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়। তবে রাজধানীর নতুন অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শেরেবাংলা নগর থানার আগারগাঁও অঞ্চলে প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে সিন্ডিকেট চক্রের চরম আধিপত্যের খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।
শনিবার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত ‘নতুন অফিসপাড়ায় নতুন সিন্ডিকেট’ শীর্ষক শিরোনামে এ বিষয়ে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগের ও হতাশার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উত্থান ঘটেছে নব্য এক সিন্ডিকেটের। বিভিন্ন সরকারি কাজের ঠিকাদারিতে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে প্রায় দিনই চলছে মহড়া। এরই মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক ব্যক্তিকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের বিভিন্ন উন্নয়ন ও নিয়মিত কাজ, সরকারি জমিতে মার্কেট নির্মাণ, অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য, অবৈধ জায়গায় ফার্মেসি বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে এই মাফিয়া সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এসব কাজে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শেরেবাংলা নগর এলাকার ২৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), পাসপোর্ট অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ অফিস বর্তমানে আগারগাঁও এলাকায় অবস্থিত। এসব অফিসের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্যই বাহিনী গঠন করে ত্রাস সৃষ্টি করছে এই চক্র। তারা হাসপাতালের সামনে সরকারি জমির ওপর গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থার উন্নয়ন কাজ কবজায় নিতে চেষ্টা করছে দীর্ঘদিন ধরে। কেউ কথা না শুনলে হুমকি-ধমকিসহ চালানো হয় নির্যাতন। সর্বশেষ রোববার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী একেএম মনিরুজ্জামানসহ কয়েকজনকে মারধরও করা হয়েছে। ঘটনাটি সম্পর্কে থানাসহ অফিস হাইকমান্ড রয়েছে অবগত। সরকারি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ জনগণের সম্পদের ওপর সিন্ডিকেটের এই একচ্ছত্র আধিপত্য, অবৈধ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহার এবং সরকারি কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার এ চিত্র কারও কাছেই কাম্য নয়। সিন্ডিকেটের এ মাফিয়া চক্র সরকারি জায়গার ওপর শত শত দোকান বসিয়ে মাসিক ভাড়া, দোকান নেওয়ার অগ্রিম টাকাসহ নানাভাবে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে। কিন্তু এ টাকা যোগ হচ্ছে না সরকারের তহবিলে। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীর পকেটে যাচ্ছে এ চক্রের মাধ্যমে। এ ছাড়া রয়েছে হাসপাতাল ঘিরে ক্যান্টিন, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা, সিরিয়াল তৈরি, পার্কিং, হাসপাতালের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ, জরুরি পণ্য সরবরাহ, ফুটপাত ও হাসপাতালে সিট বাণিজ্যসহ এমন কিছু নেই, যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর আগে দেশের সরকারি বেশিরভাগ দপ্তরের ঠিকানা ছিল মতিঝিল অঞ্চলে। তখন আমরা এসব সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দেখেছি ওই অঞ্চলের এসব প্রতিষ্ঠান ঘিরে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর হওয়ায় এখন গড়ে উঠছে নতুন এ চক্র।
আমরা মনে করি, সিন্ডিকেটের এই চক্রের তৎপরতা যে কোনো উপায়ে ভেঙে দেওয়ার কোনোই বিকল্প নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে হাসপাতালের মতো ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানে যদি এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ থাকে একচ্ছত্র, তাহলে স্বাস্থ্যসেবাপ্রত্যাশীদের দুর্ভোগ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। এটি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেখানে জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকবে, সেখানে এই চিত্র সম্পূর্ণ বেমানান।
আমাদের প্রত্যাশা, শুধু শেরেবাংলায় নয়, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই সিন্ডিকেট চক্রের থাবা থেকে মুক্ত করার দ্রুত কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন