ফাদার বুলবুল অগাস্টিন রিবেরু
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৫ এএম
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ই যিশুখ্রিষ্টের পথ

সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ই যিশুখ্রিষ্টের পথ

‘বড়দিন’ একটি বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন আনন্দ-মিলন উৎসব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বড়দিন হলো যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন, খ্রিষ্টানদের একটি আনন্দ-মহোৎসব, কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টান ও অখ্রিষ্টান প্রায় সবাই এ উৎসবে শরিক হয়। বাড়িঘর সাজগোজ করে, রকমারি খাবার-দাবারের আয়োজন, নতুন পোশাক-আশাক বানায়, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজিয়ে আলোকসজ্জা করে, কার্ড ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে, উপহার আদান-প্রদান করে এবং পারিবারিকভাবে একত্রে মিলিত হয়ে নানাভাবে ও নানারূপে এ উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে। খ্রিষ্টানরা গির্জায় প্রার্থনা ও উপাসনায় অংশ নেয়; কিন্তু অন্যদের জন্য এটা শুধুই আনন্দোৎসব। খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আজকাল অনেকেই উপাসনার চেয়ে বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ সামাজিক বা পারিবারিক উৎসব পালন করতেই বেশি আগ্রহী। তাই তো অনেক সময়ই মনে হয় বড়দিন বুঝি শুধুই একটি সামাজিক উৎসব বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; কিন্তু আসলে তো তা নয়।

বড়দিন হলো যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। এই পৃথিবীর মানুষ যখন পাপের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, পাপের কঠিন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আর কোনো উপায় যখন ছিল না, তখন ঈশ্বর নিজেই জগতের সব মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে তার একমাত্র পুত্র যিশুখ্রিষ্টকে এ পৃথিবীতে পাঠান। ঈশ্বরই এ জগতে আসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। তাই বড়দিন ঈশ্বরকে সব অন্তঃকরণে ধন্যবাদ দিয়ে আনন্দ প্রকাশের দিন।

ঐতিহ্যগতভাবে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মদিন ‘বড়দিন’ পালন করা হয়। পবিত্র বাইবেলে যিশুর জন্মদিনের কথা উল্লেখ নেই। তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন নির্ধারিত হয়নি। সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে ৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার যিশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর পালন করা হয়। এদিন দেওয়ার কারণ, ওই ২৫ তারিখে পৌত্তলিক রোমানরা অজেয় সূর্যদেবতার পূজা করত যিনি মহান ও প্রধান দেবতা। রোমান সম্রাট খ্রিষ্টান হলে তিনি মানবপুত্র যিশুকে প্রধান হিসেবে দেখতে যিশুর জন্মদিনটি ওই তারিখে রাখেন আর ধীরে ধীরে ২৫ ডিসেম্বর তারিখেই যিশুর জন্মদিন সর্বজনীনতা লাভ করে। আর সর্বজনীনভাবেই সারা বিশ্বে আড়ম্বরতার সঙ্গে বিভিন্ন নামে বড়দিন উদযাপন করা হয়ে থাকে। ক্রিস্টমাস, নাভিদাদ, নাতালে, নুয়েল, ভাইনাখটেন প্রভৃতি ইউরোপীয় শব্দ দিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যিশুর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হলেও বাঙালির হৃদয়ে সেগুলো খুব একটা আবেদন সৃষ্টি করে না যেমনটি করে ‘শুভ বড়দিন’। বড়দিনকে আমরা আপন করে নিয়েছি। এটি একান্তই আমাদের। তাই তো বাংলাদেশি খ্রিষ্টানরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে ওঠেন, যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন, সবার বড়দিন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘বড়দিন’ বড় হয়ে উঠছে ও অনেকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন রূপ পাচ্ছে।

যিশুর জন্মদিন বা বড়দিন পালনের মূলেই রয়েছে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা। বাইবেলের আদিপুস্তকে বর্ণনা আছে, ভালোবেসেই ঈশ্বর উত্তমরূপে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষকে আপন প্রতিমূর্তিতেই সৃষ্টি করলেন এবং বিশ্ব সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিলেন। মানুষ তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়ে ওঠে স্বার্থবাদী, ভোগবাদী ও উচ্চাভিলাষী। ভালোবাসার পরিবর্তে তার হৃদয়ে স্থান পায় অহংকার। ফলে শুরু হয় মানুষের পতন। পাপ এসে গ্রাস করতে থাকে মানবকুলকে। এমনিতরো অবস্থায় ঈশ্বরই তার নিখাদ ভালোবাসার কারণে উদ্যোগ নিলেন মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করতে।

বাইবেলের ভাষায়, ‘যে জাতি চলছিল অন্ধকারে তারা আজ দেখতে পেয়েছে এক মহাজ্যোতি’। যিশু নিজেই সেই মহাজ্যোতি যিনি ঈশ্বরের কাছ থেকেই নেমে এসেছেন আর যিনি পৃথিবীর সব জাতির সব দেশের ও সব কালের মানুষকে আলোর পথ দেখাবেন। তিনি এ পৃথিবীর পাপ-পঙ্কিলতা দূর করে ভরিয়ে দেবেন আলোর ঝলকানিতে। আর তা করতে অসীম ঈশ্বর সসীম মানুষ হলেন।

আকারে-প্রকারে মানুষ হয়েই জন্ম নিলেন। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, যিশু হলেন ঈশ্বর-তনয়, যিনি পবিত্র আত্মার শক্তিতে অলৌকিক মারিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে মানববেশে এ জগতে এসেছেন। ঈশ্বর মানুষ হয়ে মানুষকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। ঈশ্বরের মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার দিনটি তাই সংগত কারণেই বড়দিন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, যিশুর জন্মের কথা ইহুদি জাতি আগে থেকেই জানত। কেননা শাস্ত্রবাণীতে যিশুর আগমনের কথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে; তিনি হলেন প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা, অনন্য মন্ত্রণাদাতা ও শান্তিরাজ। ফলে ইহুদিরা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হতে ক্ষমতাবান এক রাজার প্রত্যাশা করছিল। তাদের চিন্তাচেতনার ব্যত্যয়ে অতি সাধারণ দীনহীন শিশুর বেশে যিশু রাজার আগমনকে আত্মচিন্তায় মগ্ন ও অহংকারে স্ফীত ইহুদিরা গ্রহণ করতে পারেনি। মানবদেহধারী নম্র ঈশ্বরকে মেনে নিতে না পারায় যিশুর জন্ম তাদের জীবনে কোনো আনন্দ নিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু যিশুর জন্ম ‘বড়দিন’ প্রকৃতপক্ষে আনন্দের উৎসব। বড়দিনের প্রথম উদ্দেশ্য একটি অনুষ্ঠান বা আনন্দ উৎসব উদযাপন করা। আমরা তা শিখি শিশু যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের রাখালদের কাছে স্বর্গদূতের উচ্চারিত বাণী থেকে। স্বয়ং ঈশ্বর এক বিস্ময়কর আনন্দ সংবাদ জানাচ্ছেন, যাতে করে আমরা সবাই উল্লসিত হই আর উৎসব করি। ‘আমি এক মহাআনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে’ (লুক ২:১০)। এই আনন্দ উৎসব হয় পরিবারের সবাইকে। কেননা ঈশ্বর একটি সাধারণ পরিবারের মাধ্যমে এ পৃথিবীতে আসলেন। যাতে করে ধনী-গরিব সব ব্যক্তি ও পরিবারই যেন তাকে গ্রহণ করে পারস্পরিক আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। করোনাকালে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সারা বিশ্ব একটি পরিবার। এই বিশ্ব পরিবারের একজনও যদি আক্রান্ত থাকে, তাহলে আমরা কেউই নিরাপদ নই। ঠিক তেমনি আমাদের একজনও যদি নিরানন্দে থাকে তাহলে আমাদের আনন্দ পরিপূর্ণ নয়।

বিজয় দিবসের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে উৎসব আর সেই উৎসবের পালে হাওয়া দিচ্ছে খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের বড়দিন উৎসব। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ দেশ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী সবার। মুক্তিযুদ্ধে সবাই হাতে হাত রেখে পরস্পরের পাশে থেকে জীবনপণ যুদ্ধ করে গৌরবময় বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। সেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বড়দিনের আনন্দ আরও বড় হয়ে উঠুক। বড় হব দানে-জ্ঞানে, ক্ষমা-মার্জনায়, মনে-মননে, দয়া-দাক্ষিণ্যে, প্রেম-সেবায়, সততা-বিশ্বস্ততায়, অনন্য আন্তরিকতায়। তাই বড়দিনের উৎসবে যেন সব মানুষের অন্তরে, বিশেষভাবে খ্রিষ্টানদের অন্তরে, যিশুখ্রিষ্টের প্রতি বিশ্বাসের দৃঢ়তা জেগে ওঠে। পাপের পথ ছেড়ে পবিত্রতার পথে এগিয়ে যেতে, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যেতে তারা যেন সাহসী হয়ে ওঠে। সবাইকে শুভ বড়দিন।

লেখক: পরিচালক, খ্রিষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্র

সম্পাদক, সাপ্তাহিক প্রতিবেশী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজা যুদ্ধবিরতিতে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে : ট্রাম্প

পুলিশের কাছ থেকে মাদক ব্যবসায়ীকে ছিনতাই, এসআইসহ আহত ২

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

বিক্ষোভে অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

০৯ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

একাধিক দেশের পাসপোর্টধারীরাই ‘সেফ এক্সিটের’ তালিকা করে: আসিফ মাহমুদ

শহিদুল আলমের মুক্তির জন্য সোচ্চার হতে হবে : তাসলিমা আখতার

স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস আনোয়ারুজ্জামানের

সবাইকে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব: নীরব

১০

‘হামজা আমার দলে হলে বেঞ্চেই বসে থাকত’

১১

লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের সঙ্গে বাসস চেয়ারম্যানের মতবিনিময়

১২

আফগানদের কাছে হারার পর যা বললেন মিরাজ

১৩

অল্প পুঁজি নিয়ে আফগানদের সাথে পারল না বাংলাদেশ

১৪

‘দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে’

১৫

রাবেতাতুল ওয়ায়েজীনের সঙ্গে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদের মতবিনিময়

১৬

ডিএনসিসি এলাকায় টাইফয়েডের টিকা পাবে ১৩ লাখ শিশু

১৭

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৯ কোটি ডলার

১৮

৭ বছর পর শহীদ জিয়ার মাজার জিয়ারত করলেন খালেদা জিয়া

১৯

ফার্মগেটে ককটেল বিস্ফোরণ

২০
X