পরিচিত দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। বয়স হয়েছিল ঠিক একশ বছর। সফল প্রেসিডেন্ট বলে বিবেচিত হননি। রোনাল্ড রিগ্যানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ভোটারদের পর্যাপ্ত সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে সরে গেলেন, বয়স ছাপ্পান্ন বছর মাত্র। দীর্ঘজীবী কার্টার বাকি সময় ব্যয় করেছেন মানবহিতৈষী তৎপরতা ও শান্তি স্থাপনের দৌত্য কর্মে। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কার্টার ফাউন্ডেশন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে উজ্জ্বল না হলেও অবসরপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অবদান সর্বজন স্বীকৃত। অনেকের মত হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
১৯৭৭-এর ১৬ জুন ভয়েজার ১-এ (Voyeger 1) অন্য কোনো মহাজাগতিক সভ্যতাকে উদ্দেশ্য করে কার্টার যে রেকর্ডেড বার্তাটি প্রেরণ করেছিলেন, সেটি নিম্নরূপ। তিনি লিখেছেন—
‘এই মহাশূন্য যানটির নির্মাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের গ্রহে ৪০০ কোটি মানুষের বসবাস। তার মধ্যে আমরা আমেরিকানরা হচ্ছি ২৪ কোটি মানুষের একটি ক্ষুদ্র জনবসতি। যদিও মানব প্রজাতি বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রে এখনো বিভক্ত হয়ে আছে, কিন্তু একটি অভিন্ন একক মানবসভ্যতা গঠনের পথে আমরা দ্রুত ধাবমান। আমাদের বার্তা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশ্যে। আমাদের গ্রহ সম্ভবত আরও শতকোটি বছর টিকে যাবে, যদিও ভূপৃষ্ঠে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটবে এবং সভ্যতাও রূপান্তরিত হয়ে চলবে। আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জ মিল্কিওয়েতে ২০০ কোটি তারকা রয়েছে। কাজেই এর কোনো এক বা কয়েকটি গ্রহে সভ্যবসতি বা শূন্য পরিভ্রমণরত সভ্যতার অস্তিত্ব সম্ভব। যদি এমন কারও সঙ্গে ভয়েজারের সংযোগ হয়, যদি পাঠোদ্ধার করতে পারেন, আপনাদের জন্য আমাদের দূরবর্তী গ্রহের পক্ষ থেকে এ হচ্ছে সামান্য উপহার। এতে রয়েছে আমাদের বিজ্ঞান, আমাদের প্রতিকৃতি, ধ্বনি, সংগীত, চিন্তা ও অনুভূতির নমুনা। আমরা আমাদের সময়ে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সময় ফুরিয়ে গেলে যাতে আপনাদের সময়ের অংশীদার হতে পারি। আমাদের আশা, কোনো একদিন সব সমস্যার সমাধান করে আমরা এক মহাজাগতিক সভ্যতায় মিলিত হব। এক অন্তহীন বিশাল পরমাশ্চর্য বিশ্ব জগতের কাছে আমাদের বার্তা মানবজাতির আশাবাদ, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও শুভকামনাকে প্রতিনিধিত্ব করে।’
জিমি কার্টার মানবিক প্রজ্ঞা ও শুভবোধে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই নির্দ্বিধায় অনাগত কাল এবং মহাজাগতিক সময়ে মানুষের সভ্যতার বিকাশ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু বাস্তব বড় নিষ্ঠুর, মানবজাতির পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাধার দেয়াল। ইতোমধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে পরাশক্তিদের মধ্যে নতুন শীতল যুদ্ধ ও পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কা, রক্তচোখ মেলেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়, স্বনিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক বুদ্ধির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গড়পড়তা মানুষ। মানব প্রজাতির ধ্বংসে এর কোনো একটিই যথেষ্ট, যদিও এর উৎস মূলে এক ও অভিন্ন পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ হচ্ছে সামূহিক অশুভ, গ্রিক কিংবদন্তির বহু মাথাবিশিষ্ট দানব হাইড্রা, যার রূপান্তর ব্যতিরেকে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
পুঁজিবাদের কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র। পরলোকগত জিমি কার্টার ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তি কার্টার ছিলেন সৎ ও সত্যবাদী, অঙ্গীকার করেছিলেন রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা, অর্ধসত্য বা দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি তিনি পরিহার করবেন। কথা রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু এর জন্য চড়া দাম দিতে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদ। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে ব্যর্থদের তালিকায় তার নাম। বিয়ে করেছিলেন স্কুলজীবনের প্রেমিকা রোজালিনকে। এক বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত ৭৮টি বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা, আস্থা ও নির্ভরতার বন্ধনে। ছিলেন দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিশ্ব নাগরিক, শান্তির অন্বেষায় বিশ্ব পরিব্রাজক। আরব-ইসরায়েল সমঝোতার সূচনা ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তির তিনি ছিলেন হোতা। তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি হোয়াইট হাউসের ছাদের ওপর সোলার প্যানেল স্থাপন করেছিলেন। বিপুল পরিমাণ প্রমাণিত জীবাশ্ম জ্বালানির উৎসস্থল, দুর্লভ ইউরেনিয়াম ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের হাতছানি এবং আকর্ষণীয় পর্যটন বাণিজ্যের হস্তক্ষেপ থেকে আলাস্কার প্রকৃতি, পরিবেশ ও আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা রক্ষার জন্য পুঁজিবাদের লোভাতুর দৃষ্টি ও চাপ উপেক্ষা করে বিস্তীর্ণ এলাকাকে ঘোষণা করেছিলেন সংরক্ষিত পার্ক ও বনভূমি হিসেবে। পুঁজিবাদের তীর্থভূমি যুক্তরাষ্ট্রে এটি সহজসাধ্য ছিল না। কার্টার পুঁজিবাদী ছিলেন, কিন্তু বল্গাহীন অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের অনুসারী ছিলেন না।
তার ফেলে আসা জুতোয় আজ পা গলাচ্ছেন কে? তার নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার খ্যাতি মিথ্যা ভাষণে পারদর্শিতায়, যিনি নাম কুড়িয়েছিলেন প্লেবয় হিসেবে। তার গর্বিত উক্তি হচ্ছে, দূরবর্তী ভিয়েতনামে নয়, নিউইয়র্কের পাঁচতারা হোটেলের কোমল শয্যা ছিল তার যৌবনের যুদ্ধক্ষেত্র, ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষ ছিল পছন্দের নারীরা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বাধ্যতামূলক যোগদানে ফাঁকি দিয়েছিলেন, মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, যৌনযুদ্ধের আকর্ষণে।
আর্কটিকের বরফ গলছে দৃষ্টান্তহীন দ্রুতগতিতে, বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম হারাম। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অশুভ লক্ষণ, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ ভেবে প্রাজ্ঞজন চিন্তিত। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার বিলিয়নিয়ার বন্ধুদের জন্য এটি অভূতপূর্ব সুযোগ। নিউইয়র্কের সুপরিচিত এই জমি ব্যবসায়ীর চোখ নিবদ্ধ আর্কটিকে। বরফ আবৃত গ্রিনল্যান্ড তিনি কিনে নিতে চান। বরফ গলিয়ে, আবরণ সরিয়ে, মাটি খুঁড়ে তারা উত্তোলন করবেন দুর্লভ খনিজসম্পদ, নিয়ন্ত্রণ করবেন আর্কটিকের সঙ্গে আটলান্টিকের সংযুক্তির উন্মুক্ত সমুদ্রপথ। তারা মুনাফা ও ক্ষমতার পূজারি। প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয়ে তাদের ঝুঁকি নেই, ব্যক্তিগতভাবে সর্বাবস্থায় তারা নিরাপদ। যুক্তরাষ্ট্র অমিত সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র, সেই ক্ষমতা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতের মুঠোয়। তিনিই সর্বেসর্বা। কাজেই হোয়াইট হাউসে প্রবেশের আগেই তিনি শত্রুমিত্র নির্বিশেষে পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল, হুমকিধমকি এবং পেশি স্ফীত করে ভয় দেখাতে শুরু করেছেন। কার্টার পানামা খালের কর্তৃত্ব বৈধ দাবিদার পানামা সরকারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, ট্রাম্প বলছেন তিনি তা কেড়ে নেবেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে সম্বোধন করেছেন গভর্নর ট্রুডো। অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা না শুনলে কানাডার পরিণাম হবে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্যে।
প্রেসিডেন্ট কার্টার বিপন্ন বোধ করেছিলেন, প্রয়োজনে পারমাণবিক যুদ্ধ বোতামটি টেপার দায়িত্ব তার। তিনি জানতেন সে যুদ্ধের নিয়তি মহাপ্রলয়, সভ্যতার বিপর্যয়। এ থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজেছিলেন অন্য পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। জিমি কার্টার ছিলেন সজ্জন মানুষ, আশায় বুক বেঁধে মানবজাতির দূর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পেরেছিলেন। বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প আত্মসর্বস্ব ক্ষমতালোভী একজন মানুষ। তার ভাবনার শুরু এবং শেষে শুধু তিনি, বড়জোর তা প্রলম্বিত তার পরিবার, অনুগত ও অনুগ্রহভাজনরা পর্যন্ত।
এমন একজন মানুষের হাতে রয়েছে বিশ্বকে ধ্বংসের চাবিকাঠি, পারমাণবিক যুদ্ধের বোতাম। প্রয়োজনে অথবা নিছক খেয়ালের বশে তিনি তা ব্যবহারে সক্ষম। মানবসভ্যতা সত্যি আজ বড় বিপদের মুখোমুখি।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক