অধিকাংশ ক্ষেত্রে দম্ভ বা অহংকার সাধারণত জ্ঞান এবং ক্ষমতা—এ দুটো বিষয়ের সঙ্গে আনুপাতিক হারে পরিবর্তিত হতে থাকে। শুধু তারাই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকেন এবং যুগে যুগে মানুষের কাছে তাদের কর্ম অনুকরণীয় হয়ে থাকে। জ্ঞান সৃষ্টিকর্তার এমন একটা উপহার, যা মানুষকে পরিপূর্ণ করে। একজন সত্যিকারের জ্ঞানী কখনোই দাম্ভিক বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না। জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিনয় ও সদাচরণের ধরন এবং মাত্রাও বাড়তে থাকে। ক্ষমতার অন্য পৃষ্ঠায় রয়েছে সম্পদ বা বিত্ত। অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্ষমতার ধরন ও বিবর্তনের নির্যাস হচ্ছে যারা বিত্তবান ছিলেন প্রায় তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাধর ছিলেন। অথবা যারা ক্ষমতা পেয়েছেন তারা ক্রমেই বিত্তবান ও স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন। সামন্য কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন, যারা প্রকৃত জ্ঞানী ছিলেন। সে কারণে তাদের ক্ষমতা ও জ্ঞানের একটা ভারসাম্য তাদের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। জ্ঞান এমন একটা বিষয় যার কোনো সমাপ্তি নেই, সীমানা নেই, নেই পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র। অন্যদিকে ক্ষমতা বা বিত্ত এগুলোর সীমা রয়েছে। এগুলো পরিমাপ করার যন্ত্রও রয়েছে। তাহলে আপনি কতটুকু জানলে নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে পারবেন? এটা নিয়ে সহস্র রজনী বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে, আমার মতে আমি আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যখনই সম্পূর্ণ অবগত থাকবে এবং সে সীমাবদ্ধতা মেনে নিজেকে পরিচালিত করে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সচেষ্ট থাকব, তখনই আমি সঠিক পথে থাকব। আর সঠিক পথে থাকার প্রয়াসই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানী লোকের কাজ। যারা নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করে তাদের হাতে বিত্ত, ক্ষমতা এমনকি রাজদণ্ড তুলে দিলেও সেটা নিরাপদ থাকবে।
মানব সৃষ্টির প্রথম থেকেই দায়িত্বহীন মানুষদের দায়িত্ব নেওয়ার সুপ্ত অথচ উদগ্র একটি বাসনা রয়েছে। যদিও তারা জানেন দায়িত্বের জন্য তিনি যথেষ্ট যোগ্য নন। তথাপি দায়িত্ব পালনের চেয়ে পরিচিতিটা তাদের কাছে লোভনীয়। যে পরিচিতি ক্ষমতায় রূপ নেয় এবং বিভিন্ন কাজেকর্মে ব্যবহার-অপব্যবহার দুটোই করা যায়। আর এ পরিচিতি থেকে তৈরি হয় এক ধরনের অহম বা দাম্ভিকতা। দায়িত্বশীলরা জানেন পরিচিতি বা সুনাম নিয়ে দায়িত্ব পালন কতটা কঠিন। তাই তারা একটু দূরে দূরে থাকতে চান। তাদের খুঁজে এনে দায়িত্ব দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ধরে-বেঁধেও দায়িত্ব দিতে হয়। যার সুনাম যত বেশি তার জন্য দায়িত্ব পালন করাটাও তত কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। সংগত কারণেই পথে, মাঠে, ঘাটে এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য দায়িত্ববানদের চেয়ে দায়িত্বহীনদের বেশি দেখা যায়। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমন হাভাতের দেখা পাওয়া তো ডাল-ভাতের মতো।
জ্ঞান সূচকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা নিয়ে বলার খুব কিছু নেই। আমাদের দেশে জ্ঞান সূচক নিয়ে পণ্ডিতরা যখন একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকেন, তখনই বোঝা যায় জ্ঞান সূচকের নিম্নগামিতা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। যার কাজ জ্ঞান বিতরণ করা তিনি যদি তার কাজ না করে অন্যের সমালোচনায় লেগে যান, তাহলে অন্যদের আর দরকার কী! আমাদের দেশে সমালোচনা করা খুব সহজ এবং বিনোদনমূলকও বটে। আমাদের এই দেশটাতে গত ৫৪ বছরে একটানা কতদিন নির্বিঘ্নে কাটাতে পেরেছি? একদল ক্ষমতায় গেলে অন্য দলকে নিষ্পেষিত করতে তার হতে থাকা সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে। প্রশাসনের সব স্তরে অনুগত লোকবল নিয়োগের প্রচেষ্টা হয়েছে। মতবিরোধ হলে কণ্ঠস্বর রোধ করার চেষ্টা হয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি সরকারদলীয় সমর্থন যে অঞ্চলে কম সে অঞ্চলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়নের প্রয়োজন হলেও সেই অঞ্চলে তেমন উন্নয়ন করা হয়নি। বিরোধী দলে থেকে সরকারদলীয় নেতাদের অপকর্ম নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা নেতারাই আবার ক্ষমতায় গেলে সেই একই কাজ করেছেন। কতটা নির্লজ্জ হলে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকাতে আবার পূর্ববর্তী সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেন। এ যেন চোরের মাসির বড় গলা! দেশের রাজনীতি জনহিতকর সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে খুব নোংরা ও স্বার্থপর একটা কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রায় সবাই অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে, নয়তো জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছে। আবার বিকল্প পন্থা হিসেবে ক্ষমতার উত্তরসূরি হিসেবে যাদের তৈরি করা হয়েছে, তারা শুধু নিজ বলয়েরই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে নিজ রক্তেরও। এই চিত্র কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিষবৃক্ষের মতো ছেয়ে গিয়েছে। ফলে অপেক্ষাকৃত উত্তম ও যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই নেতৃত্বে আসতে পারেনি। দিন শেষে যা হওয়ার তাই হয়েছে—কাজের চেয়ে বাগাড়ম্বর বেশি। একটা শক্তিশালী গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির পরিবর্তে বিদেশি শক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। এসব সইতে গিয়ে অসহায় জনগণ একটা সময় বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় অন্য একটি ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী এ বিভ্রান্ত মানুষগুলোর আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। দেশে এত ফ্যাসাদ, এত বিবাদ, এত দলাদলি এগুলো কার স্বার্থে? জনগণের? নাকি ক্ষমতালিপ্সু তথাকথিত কিছু নেতার?
শেখ হাসিনা সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী ছিল। টানা সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না করে তিনি রাজনৈতিক হয়রানির চরম উদাহরণ তৈরি করেছেন। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন। বিত্তশালীদের ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে গুটিকয়েক অলিগার্ক তৈরি করে অর্থ ও প্রশাসন দুটোই নিয়ন্ত্রণ করেছে বিধায় ৫ আগস্টের মতো ব্যতিক্রমী একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। অবশ্য এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল। সেটা ২০২৪ সালে না হলেও একটা সময় ঠিকই হতো। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য লোকের চরম সংকট থাকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একরকম খুঁজে এনে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি একজন জ্ঞানী মানুষ এতে কারও দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তবে তার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের অধিক্ষেত্র হচ্ছে অর্থনীতি, যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে জ্ঞান ও কৌশল জানা প্রয়োজন তার একটা অংশ মাত্র। তার মধ্যে যথেষ্ট বিনয় রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে মানবিকতার ছাপ। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে কঠোর হতে হয়। চরম ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নিজের ও পরিচিত অনেকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়। নিরপেক্ষতার স্বার্থে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষমতা নেওয়ার প্রায় ছয় মাস হলেও তিনি বিনয় ও সরলতা ছাড়া অন্য কোনো রূপ ধারণ করতে পারেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তার সহকর্মী হিসেবে যাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন এবং যাদের তিনি চেনেন এমন লোকজন নিয়েই তিনি সরকার গঠন করেছেন। এ কথা তিনি নিজ মুখেই গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব ভাষা রয়েছে। রাষ্ট্রের নিজস্ব একটা গতি রয়েছে। সেই ভাষা ও গতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা বা এতদসংক্রান্ত তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক জ্ঞানে জ্ঞানী এই পরিষদে কয়জন আছেন? তা ছাড়া যতটুকু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে, তা প্রয়োগ করার ইচ্ছা ও স্বাধীনতাটাও জরুরি। যিনি সুইজারল্যান্ডে চার দিনের সফরে ৪৭টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারেন; তিনি দেশের জনগণ, প্রশাসন, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সাধারণ জনগণের বিভিন্ন ফোরাম ও সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছয় মাসে কতগুলো সংলাপ করতে পারতেন আর কতগুলো করেছেন? সংলাপ ছাড়া যে কোনো সিদ্ধান্ত দুর্বল হয় সেটা তো প্রমাণিত সত্য। বিশ্বের সব জটিল ও কুটিল রাজনৈতিক সংকট একটা সময়ে সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান করতে হয়েছে। অথচ এই সরকার সংলাপে অনেকটা উদাসীন। আশা করি তারা এখন নিজেরাই বুঝতে পারছেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা তারা কতটুকু পূরণ করতে পারছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে কতটুকু পারবেন।
সব দলের মধ্যে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐক্য ছাড়া এ দেশে কোনোদিন স্থায়ী সংস্কার বা স্থিতিশীলতা আসবে না। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, দেশ পরিচালনার মূলনীতি, প্রতিরক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতির মতো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য আসাটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সব রাজনৈতিক দল যদি তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে এই মৌলিক বিষয়গুলো একই ভাবধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে এবং সেভাবে পালন করতে পারে, তবে এই দেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণের কাছে জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করা একান্তই অপরিহার্য বিষয়। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জনগণ এটুকু পেলেই খুশি। কিন্তু কবে সেই খুশির দিনটি দেখতে পাব? অসহায়ের মতো হাত কামড়ানো ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি? আমরা কি রাষ্ট্রের প্রজা থেকে একজন সক্রিয় অংশীদার হতে পারি না?
লেখক: সাধারণ নাগরিক ও থিয়েটার কর্মী
ইমেইল: [email protected]