আকমল হোসেন
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১৭ এএম
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষায় ন্যায্য বাজেট ও তৃণমূলের ভাবনা

শিক্ষায় ন্যায্য বাজেট ও তৃণমূলের ভাবনা

নোবেল লরিয়েট বাঙালি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন তার এক গবেষণায় লিখেছেন, খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি, দুর্ভিক্ষ হয়েছে বণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্যের কারণে। বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের গরিবানার কারণটাও ঠিক সে রকমই। আর্থিক সংকটের জন্য নয়, সরকারগুলোর আন্তরিকতা আর সদিচ্ছার কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রের দৈন্যদশা।

শিক্ষা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ ধারায় নাগরিকের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই তো দুবার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত (১৯৪৭ ও ১৯৭১) এবং দুবার স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ (১৯৯০ ও ২০২৪) বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পরও সবার জন্য শিক্ষা এবং গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও শিক্ষা বাজেট নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংগঠনগুলো এবং বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন বা এনজিওদের। তবে সাধারণ মানুষের যেমন এ বিষয়ে বড় একটা তাগিদ নেই, তেমনি পুঁজিবাদের অনুসারী বড় বড় রাজনৈতিক দলের আন্তরিকতাও নেই। মানুষ সচেতন হলে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যাবে না—এ বিষয়টি মৌলবাদী ও পুঁজিবাদের অনুসারী শাসকরা ভালোভাবেই বুঝেছে। তাই ২৪ বছর পর্যন্ত বয়সের ৪১ ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়েছে। এরপরও মধ্য আয়ের দেশ বলে প্রচারের গগনবিদারী প্রচার লক্ষ করা যায়। নির্বাচনী মৌসুমে ভোট প্রাপ্তির আশায় নির্বাচনী ইশতেহারের বাইরে ডকুমেন্টহীন রাজনৈতিক বক্তব্যে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শিক্ষা কার্যক্রমটা কারও একার বিষয় নয়, ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত এবং ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এটা নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে যার যতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্য সেটা পরিষ্কার যেমন হওয়া দরকার, তেমনি সে দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করাও প্রয়োজন। কারণ বস্তিতে জন্ম নেওয়া আর গুলশান-বনানীতে জন্ম নেওয়া ছয় বছরের আজকের সন্তানটি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তার ওপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ এবং বিশ্বের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। বিষয়টি বিবেচনা করেই বর্তমানের নীতিনির্ধারক গবেষক এবং ভূমিষ্ঠ হওয়া ওই সন্তানের অভিভাবকদের ভবিষ্যৎ রচনা করতে হবে। নইলে বারবার হতাশ হতে হবে। বিদ্যালয়ে আসার আগেই শিশুর শিক্ষণ কাজ শুরু হয়। প্রথমে মা-বাবা, পরে পরিবার ও প্রতিবেশ থেকে। তবে শিক্ষণ পরিবেশ বিদ্যালয়ের আগে পরিবারে এবং সমাজে প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকার কথা বলেছেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। দেশ, জাতি, সমাজ ও সভ্যতা বিবেচনা করেই পরিবার-সমাজকে তাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার জন্য বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। কারণ শিশুরা শিখে দেখে, শুনে করে ও পড়ে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সে কারণে পরিবার এবং কমিউনিটির আর্থিক সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এ কাজটি করার জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করার প্রয়োজন। চুল-দাড়ি কাটার জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কাউকে অর্থ সরবরাহ করা হয়; অন্যদিকে প্রকল্প আর অনুদানের টাকায় শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিচালনা করলে সেখানে দৈন্যদশা কেয়ামতের আগে কাটবে বলে মনে হয় না। তার উদাহরণ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। শিক্ষার দর্শন কী হবে? শিক্ষা শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষিত ডিগ্রিধারী বানাবে না মানবিক গুণসম্পন্ন সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী মানুষ বানাবে? সেই কারণে আন্তর্জাতিকভাবে দাবি উঠেছে কোয়ালিটি, ইক্যুইটি ইনক্লুসিভ এবং লাইফলং শিক্ষা বাস্তবায়নের। এই শিক্ষা বাস্তবায়নে দক্ষ, যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত উপকরণ এবং গবেষণা কাজ। কাজটি কঠিন হলেও করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে।

সবার জন্য একটা স্তর (প্রথম-দ্বাদশ শ্রেণি) পর্যন্ত শিক্ষার দায় সরকারকে নিতে হবে। সরকার আন্তর্জাতিক অনেক ডিক্লারেশনে সেই সম্মতি দিয়েছে। কারণ জাতিসংঘভুক্ত সব দেশের সরকার ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব নাগরিককে শিক্ষা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১৯৪৮ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে, সেটি আরেকবার সম্মতি দিয়েছে ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন সম্মেলনে গৃহীত এসডিজিসের ডিক্লারেশনে। সেই আলোকে জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী জিডিপির সাত ভাগ অপারগতায় ছয় ভাগ ব্যয় করার অঙ্গীকার করেছে। সে আঙ্গিকে বাজেট করলেই প্রতি বছর বাজেটের আগে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা মানুষের দৌড়ঝাঁপ করা প্রয়োজন হয় না এবং সরকার বাহাদুরকেও বেশি টেনশনে থাকার প্রয়োজন হয় না।

স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ২.৪ ভাগ আর সর্বনিম্ন বরাদ্দ ১.৬৭ ভাগ, সেটাও বর্তমান অর্থবছরে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষায় কম বরাদ্দ বাংলাদেশে। একবারে না পারলেও বারবার আংশিক করে দিয়ে বাজেট বাড়ানো যেতে পারে। শিক্ষা খাতে আয়ের নতুন নতুন খাত বের করা যেতে পারে। শিক্ষা যেহেতু সব নাগরিকের জন্যই দরকার; সে কারণে অন্যান্য করের সঙ্গে শিক্ষা কর ধরা, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা তহবিলে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনুদান গ্রহণ, কোম্পানিগুলোর সিআরএসের টাকা শিক্ষা খাতে আদায় করে শিক্ষা খাতের বাজেট বাড়ানো যেতে পারে। অন্যদিকে বর্তমানে শিক্ষায় বরাদ্দকৃত টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টাকা প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় না দেওয়া। প্রকল্পের নামে হরিলুটের কালচার বন্ধ করা এবং শিক্ষায় বরাদ্দকৃত টাকা অব্যহৃত না রাখার মধ্য দিয়ে শিক্ষায় অর্থ সংকট কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে। সেইসঙ্গে প্রতি বছর অল্প অল্প বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার আর্থিক সংকট কাটানো যেতে পারে। শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে বৈষম্যের যে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে, তা না ভাঙলে সমাজের বৈষম্যও কমবে না। মফস্বলের মানুষ, হাওর, বাঁওড়, পার্বত্য অঞ্চল, চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ছেলেমেয়েকে শিক্ষার মূলধারায় আনতে বিশেষ ব্যবস্থা করা জরুরি। আর এ কাজগুলো করতে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা। সেখানে আর্থিক বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষা, শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই ঝরেপড়া ৪১ শতাংশ (প্রাথমিক স্তরে ১৩ ও মাধ্যমিক স্তরে ২৮ ভাগ) শিক্ষার্থীর শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে বয়স্ক শিক্ষা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার এবং ভোকেশনাল শিক্ষার জন্য প্রাথমিক ও গণসাক্ষরতা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। বাজেটের সময় এলে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হলেও তারপরই সবাই ভুলে যায়। বিত্তশালীরা তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়ায়। তাই দেশের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য মাথাব্যথা নেই। আবার শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধিরও চেষ্টা নেই। জানি না এ সংকট কবে দূর হবে?

লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘অগ্নি-৫’ বাঙ্কার বাস্টার বানাচ্ছে ভারত

দিঘিতে গোসলে নেমে দুই শিশুর মৃত্যু

যুক্তরাজ্যে বেনামে ফ্ল্যাট কিনেছেন নেতানিয়াহুর ছেলে

জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ক্ষোভ

পরিচয় মিলেছে কারাগারে বন্দি আশা বানুর, দেওয়া হলো পিতার জিম্মায় 

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাট্টা ওবামা-বুশ

বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালক মামুনের বদলি 

ইয়াবা লুটের অভিযোগ : ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ

১৯ জুলাই ‘জাতীয় সমাবেশ’ সফল করুন : গোলাম পরওয়ার

দেশে মুক্তি পাচ্ছে হলিউডের দুই সিনেমা

১০

পিলখানায় বৃক্ষরোপণ অভিযানের উদ্বোধন বিজিবি মহাপরিচালকের

১১

ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ২৫৬৪৫ জন

১২

চূড়ান্ত হলো শাকিব খানের নতুন সিনেমা

১৩

ডেঙ্গু প্রতিরোধে নূরুল ইসলাম মণি ফাউন্ডেশনের লিফলেট বিতরণ

১৪

আশুরাকে কেন্দ্র করে সুসংহত নিরাপত্তা গ্রহণ ডিএমপির

১৫

অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন ভারতীয় নাগরিক, অতঃপর...

১৬

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সম্ভব না : এ্যানি

১৭

পুকুরে ডুবে প্রাণ গেল দুই ভাইয়ের

১৮

ভারতে পাকিস্তানি তারকাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার?

১৯

তুরস্কের ‘খপ্পর’ থেকে বাঁচতে ইসরায়েলে ঝুঁকছে সিরিয়া

২০
X