আজ ২১ আগস্ট। সেই রক্তস্নাত বিভীষিকাময় দিন। ১৯ বছর আগে ২০০৪ সালের এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মানুষের আর্তনাদ আর কাতর ছোটাছুটিতে সেখানে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। এদিন আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলপূর্ব সমাবেশে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা এবং গুলিবর্ষণ করে ঘাতকরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক।
সেদিন ছিল শনিবার। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সেই সময়ের বিরোধী দলনেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের স্রোত। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগমে রীতিমতো মহাসমাবেশে পরিণত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের চারপাশ। বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হয় নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১২-১৩টি গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্তমাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় এলাকাজুড়ে। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা।
২০০৪ সালের সেই বিকেলে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড ছুড়েই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা, গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে সেদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ঘাতকরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়েছিল। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ।
ঘাতকদের পরিকল্পিত বহুমুখী হামলায় এই দিনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বর মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সেদিন যদি ঘাতকদের ছোড়া গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো, তবে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটাই ছিল ঘাতকদের মূল পরিকল্পনা।
এ হামলায় প্রাণ হারান বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও মহিলা আওয়ামী লীগের প্রধান আইভি রহমানসহ ২৪ জন। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ গুরুতর আহত হন প্রায় ৩০০ জন। সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা এলাকা। এ ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার পর সেদিন স্প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন শত শত মানুষ। হামলায় মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে রক্তের অনাহুত আলপনা, শত শত মানুষের আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুমূর্ষুদের আকুতি, কাতর চিৎকার—অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য।
আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর অসাম্প্রদায়িকতা—এ তিনটি শব্দকে হত্যা করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দিকে গ্রেনেড ছুড়েছিল ঘাতকরা। ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতাই ছিল ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা, তথ্য-প্রমাণ নষ্ট, হত্যাকারীদের আড়াল করতে এর পর সাজানো হয় জজ মিয়া নাটক। এসব প্রতিটি উদ্যোগই ছিল বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
মন্তব্য করুন