ডেভিড হার্স্ট
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না

হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না

গাজাকে আপনি যা খুশি বলতে পারেন—মৃত্যুকূপ, রক্ত আর যন্ত্রণার এক অনন্ত চক্র, কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির। আর তেল আবিবের ইহুদিরা যেন এক ধরনের পশ্চিমা মায়াজালে বাস করছে। একটা জিনিস তারা বুঝে উঠতে পারছে না—হামাস আত্মসমর্পণ করবে না। যারা ভাবছে হামাসের নেতারা একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে টাকার বিনিময়ে পালিয়ে যাবে, যেমনটা ফাতাহ করেছিল। কিন্তু গত ১৮ মাসের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ আর সারা গাজার দুই মাসের অভুক্তি দেখেও ইসরায়েলিরা শত্রুকে ঠিকমতো বোঝেনি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অবস্থান দেখে তাই স্পষ্ট হয়।

ইসরায়েল হামাসকে যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা আসলে আত্মসমর্পণেরই নামান্তর। সেখানে বলা হয়েছে, সব ইসরায়েলি জিম্মিকে ছেড়ে দিতে হবে এবং হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে। তাহলে গাজাকে ৪৫ দিনের জন্য খাবার আর পানি দেবে ইসরায়েল। উত্তরে হামাস জানিয়েছে, তারা সব জিম্মিকে ছেড়ে দিতে রাজি, তবে এর বিনিময়ে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি ও দীর্ঘমেয়াদি একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি চায় এবং হামাস প্রতিজ্ঞা করেছে তারা নতুন করে টানেল খনন করবে না বা অস্ত্র উন্নয়নে যাবে না এবং গাজা শাসনের দায়িত্ব অন্য ফিলিস্তিনি দলগুলোর কাছে হস্তান্তর করবে। অর্থাৎ তারা এখনো দুটি শর্তে অটল আছে। তারা নিরস্ত্র হবে না এবং ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা থেকে পূর্ণ প্রত্যাহার ও যুদ্ধের চূড়ান্ত অবসান চায়।

একটি সমঝোতার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেই। দুবার হামাসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি একতরফাভাবে সেই চুক্তি ভেঙেছেন। সর্বশেষ জানুয়ারিতে তিনি পর্যায়ক্রমিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন, যার প্রথম ধাপে ৩৩ জন জিম্মি মুক্তি পায়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েলের স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে এগোনোর কথা ছিল। কিন্তু নেতানিয়াহু হঠাৎ করে সেই চুক্তি ছিঁড়ে ফেলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে তা করতে দেন।

সর্বজন স্বীকৃত সত্য হচ্ছে, নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন শুধু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য। সামরিক লক্ষ্য অনেক আগেই শেষ হয়েছে। দুই মাস ধরে গাজা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ, খাদ্য গুদামগুলোও ইসরায়েলের বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি এখন আর কোনো গোপন তথ্য নয়—তবে সেটিও কাজ করছে না।

ট্রাম্পের প্রাক্তন জিম্মিবিষয়ক দূত অ্যাডাম বোহলার ও বাইডেন প্রশাসনের দূতরা একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। হামাস যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে জিম্মি বিনিময়ে সম্মত হচ্ছিল, কিন্তু নেতানিয়াহু বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেন। বোহলার নিজেই আলজাজিরাকে বলেছেন, যদি সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হবে—হামাস এতে রাজি। কিন্তু নেতানিয়াহু সেটা চান না।

বাইডেনের সিআইএ পরিচালক বিল বার্নসের মধ্যস্থতায় এক বছর আগে যুদ্ধ শেষ করতে একটি চুক্তি হয়েছিল, যেটিতে হামাস সম্মত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহু সেই চুক্তি থেকেও সরে দাঁড়ান। অর্থাৎ এ সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন একজন মানুষ—নেতানিয়াহু।

আত্মসমর্পণের প্রশ্নই নেই—এটাই এখন গাজার বাস্তবতা। মার্চে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে দেড় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। প্রতিদিন রাতভর গাজা ও হামাসের ওপর আক্রমণ চলছে, হাসপাতাল থেকে পুলিশ সদর দপ্তর, এমনকি হামাসের প্রথম সারির নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। রাফা শহর একরকম গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু হামাস নির্বাসনে যাওয়ার বিনিময়ে যে বিপুল অর্থের প্রস্তাব পেয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

পূর্ববর্তী ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত যেমন ১৯৮২ সালে পশ্চিম বৈরুতে পিএলও বাহিনী অবরুদ্ধ হলে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন, কিংবা ফাতাহ আজ হয়তো পালিয়ে যেত—হামাসের ক্ষেত্রে এ উদাহরণগুলো কার্যকর নয়। কেন?

কারণ, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় দক্ষিণ ইসরায়েলে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ যেমন ইসরায়েলি সমাজকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, তেমনি গাজা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হামাসের সংগ্রাম চিরতরে বদলে দিয়েছে। আজ গাজা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি এখন পবিত্র এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এমন কোনো পরিবার নেই যাদের ঘরবাড়ি বা প্রিয়জন হারায়নি।

হামাস বা অন্য কোনো প্রতিরোধ সংগঠনকে গাজার সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করা অসম্ভব হয়ে গেছে। দুর্ভোগ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে নিজেদের জমিনে টিকে থাকার সংকল্প। দক্ষিণ হেবরনের নিরস্ত্র কৃষকরাও যেভাবে দখলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন, গাজার মানুষও একইভাবে জমি ছাড়ার কথা ভাবছেন না। আর একটি বড় কারণ হলো, যে শক্তির বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ, সেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের আচরণ। এক বর্ণহীন, চিরস্থায়ী ও বিষাক্ত দখলদার শক্তির মতো সে অন্য জাতির জায়গা, অস্তিত্ব, জীবনের পরিসরে অনুপ্রবেশ করছে বারবার। এ দখলদারিত্বই গাজার প্রতিরোধকে আরও যৌক্তিক, আরও অনিবার্য করে তুলেছে।

এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নয়, এটি মানসিক, সাংস্কৃতিক ও অস্তিত্বগত। গাজার মানুষের কাছে এখন লড়াই মানেই বেঁচে থাকা আর বেঁচে থাকা মানেই নিজেদের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া। আত্মসমর্পণ মানেই সবকিছু হারিয়ে ফেলা—তাই আত্মসমর্পণের কোনো জায়গা এখানে নেই।

ইসরায়েলের বসতি স্থাপন কার্যক্রম যুদ্ধের সময় নয়, বরং শান্তির সময় আরও বেশি সক্রিয় হয়। যেমনটা অসলো চুক্তির পর পশ্চিম তীরে ঘটেছিল। কারণ ইসরায়েলের দৃষ্টিতে দুটি রাষ্ট্রের সমাধান কখনোই গ্রহণযোগ্য ছিল না। শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল একটি মাত্র ‘ইহুদি রাষ্ট্র’, যার ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত ডেভিড বেন গুরিয়নের কল্পনায় ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত ভূমি’র মধ্য দিয়ে।

আজ নেতানিয়াহু, বেন গভির ও স্মোটরিচ মিলে সেই ‘অসমাপ্ত কাজটি’ (ফিলিস্তিনিদের মুছে দেওয়ার কাজ) চূড়ান্ত করে তুলছেন। ফিলিস্তিনি প্রশ্নে ইসরায়েলি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আদতে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এ বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, একই সময়ে ছয় হাজারের বেশি ইহুদি আল-আকসা মসজিদের চত্বরে প্রবেশ করেছে আর ঠিক তখনই ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট গাজার জন্য মানবিক সহায়তা পুনরায় চালুর আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল তার ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় অংশ—সবাই যেন একসঙ্গে একই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে, যদিও অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত।

এই প্রেক্ষাপটে, যদি আজ হামাস আত্মসমর্পণ করে তবে তা শুধু একটি দলের পরাজয় নয়, পুরো ফিলিস্তিনি সংগ্রামের আত্মসমর্পণ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এ প্রতিরোধই এখন দখলের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র অবশিষ্ট পথ। ফিলিস্তিনিরা গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম বা ইসরায়েলের ভেতরে, যেখানেই থাকুক, একই রকম নিপীড়নের শিকার। গাজার ধ্বংস আজ আর কেবল হামাসের নয়, পুরো ফিলিস্তিনের পরিণতির প্রতীক। আর হামাস ফাতাহ থেকে ভিন্ন। হামাস একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন, যারা আল-আকসা মসজিদে বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। আর গাজার মানুষ আজ নিজেদের যন্ত্রণার ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে ধর্মের দিকেই ফিরে যাচ্ছে। প্রতিরোধ এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, বিশ্বাস আর অস্তিত্বের লড়াই।

হামাসের আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় বিশ্বাস—এ তিনটি জিনিসই তাদের ভেতর থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করেছে। এটি শুধু সদস্যদের নয়, গাজার অনেক সাধারণ মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু হামাস যে আত্মসমর্পণ করছে না, তার পেছনে শুধু ধর্মীয় বা অস্তিত্বগত নয়; কৌশলগত কারণও আছে।

অনেক বিদ্রোহী সংগঠন যেমন তামিল টাইগারস বা চেচেন বিদ্রোহীরা সামরিক শক্তিতে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিংবা ইটিএর মতো সংগঠন বিনা ফলেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিন্তু হামাস মনে করছে তাদের মূল কৌশলগত লক্ষ্য এরই মধ্যে অর্জিত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি আবার বিশ্ব মানবাধিকার এজেন্ডার শীর্ষে তোলা এবং সেটা তারা করতে পেরেছে।

গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল সম্পর্কে জনমত উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক হয়েছে। পিউ রিসার্চের জরিপ বলছে, এখন ৫৩ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ইসরায়েল সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন, যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।

হামাস এখন জনমতের লড়াইয়ে জিতে যাচ্ছে, এমনকি সেসব দেশেও, যেখানে তারা আইনগতভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষিত। আইন হামাসকে সন্ত্রাসী ভাবতে বললেও, বাস্তবে অনেকেই তা মনে করছে না, যদিও তারা ৭ অক্টোবরের ঘটনার নিন্দা করে। গাজার প্রতিরোধ আর হামাস এখন আলাদা নয়, কারণ তাদের কৌশল শুধু অস্ত্র নয়, বৈশ্বিক বিবেকেও জেগে ওঠার এক প্রচেষ্টা।

লেখক: মিডল ইস্ট আইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক। রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক। কাজ করেছেন দ্য গার্ডিয়ানে। মিডল ইস্ট আইয়ের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন তারেক খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আরও একটি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করল পাকিস্তান সেনাবাহিনী

ছুটির ৩ দিনে ঢাকায় টানা সমাবেশ

ফেনীতে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেল বৃদ্ধের

পাকিস্তানে হামলার শঙ্কা, দুই দেশের নেতাদের ফোন করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব

কুতুবদিয়ায় কাফনের কাপড় পরে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি

আবারও ভারত-পাকিস্তান সেনাদের গোলাগুলি, তীব্র উত্তেজনা

মাটি কাটার দায়ে ৮ জনের কারাদণ্ড

ঢাকায় আজও বইছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস

কলকাতার হোটেল ভয়াবহ আগুন, নিহত ১৪

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা থেকে সরে আসার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

১০

নাতনিকে ইভটিজিং, প্রতিবাদ করায় নানাকে কুপিয়ে হত্যা

১১

বাড়িতে ঢুকে মা-বাবাকে মারধর করে মেয়েকে অপহরণ, গ্রেপ্তার ১

১২

গাজায় আরও অর্ধশতাধিক নিহত, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা অনেকে

১৩

কেমন থাকবে আজ ঢাকার আবহাওয়া

১৪

তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই : ফারুকী

১৫

শেষ হয়েছে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা, ইলিশ ধরতে প্রস্তুত ভোলার জেলেরা

১৬

পাট শ্রমিক দলের সভাপতি হলেন সাঈদ আল নোমান

১৭

সাতক্ষীরায় বিএনপির সার্চ কমিটিতে আ.লীগ নেতারা

১৮

৩০ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

২০
X