সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০১:৫৬ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

ট্রেন। ছবি : সংগৃহীত
ট্রেন। ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিগত দেড় দশকে রেলওয়ে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ সত্ত্বেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিন আমদানি করেনি রেল প্রশাসন। ইঞ্জিনের অভাবে ট্রেন অপারেশন কার্যত স্থবির হয়ে পড়লেও মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের উদাসীনতায় সংকট উত্তরণে হোঁচট খাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ গণপরিবহন সংস্থা রেলওয়ে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অঞ্চলের দৈনিক ইঞ্জিনের চাহিদা প্রায় আড়াইশ। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরোনো ইঞ্জিনের কারণে পথিমধ্যে ইঞ্জিন বিকল, ট্রেনের যাত্রা শুরু ও গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের যাত্রা বাতিলের ঘটনা ঘটছে। এতে রেলের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রেলের যাত্রী দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূলত, রেলের রোলিং স্টক ডিপার্টমেন্টের (যাান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ) উদাসীনতা ও গাফিলতিতে ট্রেন অপারেশনে সংকটে পড়েছে রেল প্রশাসন।

অভিযোগ উঠেছে, বিগত সময়ে রেলওয়ে ট্র্যাক, কোচসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও শুধু যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ পুরোনো ধ্যানে চলছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইঞ্জিন আমদানি না করে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগকে ঝুঁকিতে ফেলেছে যান্ত্রিক বিভাগ। সাম্প্রতিক সময়ে লোকোমোটিভের সংকটে বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ ও সমালোচনা শুরু হলে বিভাগটি এখনো ইঞ্জিন আমদানি কিংবা যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী লোকোমোটিভ সরবরাহ দিচ্ছে না। তা ছাড়া অদৃশ্য শক্তি নিয়ে কোনো নির্দেশনাই মানছে না অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-আরএস)। ফলে নানা সংকটে এখন ধুঁকছে রেল—এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ সুবক্তগীন কালবেলাকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকটে রয়েছি। ইঞ্জিন আমদানির একটি বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল হওয়ায় সংকট শুরু হয়। আমরা এখন বিদ্যমান ইঞ্জিনগুলো মেরামতের পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনেই ৩০টি ইঞ্জিন আমদানির পরিকল্পনা করছি। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে রেলের ইঞ্জিন সংকট কেটে যাবে। তা ছাড়া রেল প্রশাসনে যে কোনো ধরনের অনিয়ম ঠেকাতে ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্তারা মনিটরিং করছেন নিয়মিত। অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে রয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’।

তবে এই বিভাগের দায়িত্বশীল রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইঞ্জিনসহ যান্ত্রিক বিভাগের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।

রেলের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫৩ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলে ইঞ্জিন রয়েছে ১৫৩টি। ২০২৩ সালে ৩টি ইঞ্জিন চলাচলের অনুপযুক্ত করায় ইঞ্জিন রয়েছে ১৫০টি। প্রতিদিন ১১৬টি ইঞ্জিনের চাহিদার মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ৭২টি, মালবাহী ট্রেনের জন্য ১৩টি, সান্টিং-এর জন্য ১৬টি, শাটল ২টি, বিটি/প্রকল্প ২টি, রিলিফ ট্রেন ও অন্যান্য ১১টি। কিন্তু সরবরাহ পাওয়া যায় মাত্র ১০০টি।

বরাদ্দের শতভাগ সরবরাহ না হওয়ায় পূর্বাঞ্চলে ১টি ইঞ্জিন প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৩টি ট্রেন পরিচালনা করে, যা দীর্ঘদিনের পুরোনো ইঞ্জিনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এতে ট্রেনের গতি কমে যাওয়া, বিকল হওয়ার ঘটনায় ট্রেন সার্ভিসের মান পর্যায়ক্রমে কমছে। একই চিত্র দেখা গেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলেও। সিংহভাগ ব্রডগেজ লোকোমোটিভ দিয়ে ট্রেন পরিচালনাকারী এই অঞ্চলে দেড় শতাধিক ইঞ্জিনের মধ্যে প্রতিদিনের চাহিদা ১০০টিরও বেশি।

এর মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য চাহিদা ৬২টি, মালবাহীর জন্য ১৯টি, সান্টিং-এর জন্য ৫টি, প্রকল্পে ৪টি, বিটি ২টি, রিলিফ ট্রেন/আর্মি স্পেশালে ৩টি, সপ পাইলট ২টি ইঞ্জিন পাওয়া যায়। বাকি ২৮টি ইঞ্জিন মেইনটেনেন্স স্পেয়ার হিসেবে থাকে। ফলে অধিকাংশ ইঞ্জিনকেই একাধিক ট্রেনে সংযুক্ত করে ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করা হয়। একটি ইঞ্জিন দিয়ে সক্ষমতার চেয়েও বেশি ট্রেন পরিচালনার কারণে দ্রুত সময়ে ও পথে ট্রেন বিকল হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে, যা ট্রেনের সময়ানুবর্তিতায় ও শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন রেলের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ।

পূর্বাঞ্চলের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। দীর্ঘ বিরতির পর দক্ষিণ হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে ৩০টি সর্বশেষ প্রযুক্তির ইঞ্জিন আমদানি হয় ২০২১ সালে। এসব ইঞ্জিন আমদানির পর রেলের বহরে থাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুরোনো ইঞ্জিন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো দিয়ে দেশের প্রধান প্রধান রুট ছাড়াও ভারী-দীর্ঘ পণ্যবাহী ট্রেনে এসব ইঞ্জিন ব্যবহার হলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বেশ কয়েকটি ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ৩০১৫ নং ইঞ্জিনটি পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ (কেলোকা) কারখানায় মেরামতের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকি ৩০২৮ ও ৩০৩০ নং কোরিয়ান ইঞ্জিন দুটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানায় মেরামতাধীন রয়েছে। রেলের বর্তমান সার্ভিস পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা এসব নতুন ইঞ্জিন শপে আটকে থাকায় ট্রেন পরিচালনায় হিমসিম খাচ্ছে রেলওয়ের পরিবহন বিভাগ। আবার রেলের বিভিন্ন সিরিজের প্রায় অর্ধ শতাধিক ইঞ্জিন মেরামতে বিপুল যন্ত্রাংশ ক্রয়ের প্রয়োজন হলেও সেটি বরাদ্দ না পাওয়ায় সহসাই সংকট সমাধান হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, রেলের যান্ত্রিক বিভাগসহ রোলিং স্টকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ইঞ্জিন আমদানির পরিবর্তে বিদ্যমান ইঞ্জিনগুলোকে বারবার মেরামত করে সার্ভিস পরিচালনা করতে চাইছে। একটি ইঞ্জিন মেরামত কিংবা ওভারহোলিং করার পর কিছুদিনের মধ্যে ফের ত্রুটিতে পড়ে বিকল হচ্ছে।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিনের পুরোনো ইঞ্জিনগুলোতে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন, মেরামত কাজে গাফিলতির কারণে বারবার বিকলের ঘটনা ঘটছে। ইঞ্জিন বিকলের কারণে যাত্রীবাহী অনেক ট্রেন পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে মানুষের দুর্ভোগ তৈরি করেছে। এতে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীদের বিক্ষোভ, সংঘাতসহ যাত্রীরা নানা ধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে সারা দেশকে ট্রেন নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেও ইঞ্জিন আমদানি জটিলতায় রেলওয়ে এর সুফল নিতে পারছে না। ২০০৯ সালে ৭০টি ইঞ্জিন ক্রয়ের একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও ঋণের সুদহারসহ বিভিন্ন জটিলতায় সেটি ভেস্তে যায়। যার কারণে নতুন করে ছোট ছোট পর্যায়ে ইঞ্জিন আমদানির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মিটারগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা না থাকায় পরিকল্পনার পর আমদানি সময়সাপেক্ষ। যার কারণে সর্বশেষ আমদানি হওয়া ইঞ্জিনের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে রেলওয়েকে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রাংশ আমদানি কিংবা দেশীয় প্রতিষ্ঠান সংকটের নামে যান্ত্রিক বিভাগের অনিয়মের কারণে বর্তমান সরকার সরবরাহ কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। এতে আরও বেশি সংকটে পড়েছেন রেলওয়ে প্রশাসন।

রেলের পরিবহন, বাণিজ্যিক বিভাগগুলো ট্রেন অপারেশনের মাধ্যমে যাত্রী সেবা ও আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও শুধু যান্ত্রিক বিভাগের অসহযোগিতায় ট্রেন সার্ভিস বাড়াতে পারছে না। বিভিন্ন সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সুপারিশ সত্ত্বেও যান্ত্রিক বিভাগ থেকে কোচ ও ইঞ্জিন সরবরাহ দিতে অপারগতায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশের উন্নয়নে মেধাবী শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে : চসিক মেয়র

কৃষক দল সম্পাদক বাবুলের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল

চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সতর্কবার্তা / ‘সাংবাদিকরা চুপ থাকলে সমাজ অন্ধকারে ডুবে যাবে’

অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধে সিলেট জেলা পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ : পুলিশ সুপার

বগুড়ায় সাহিত্য উৎসব শুক্রবার, অংশ নিবে দুই শতাধিক কবি

বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি রোধে নতুন নির্দেশনা

জুলাই শহীদদের স্মরণে জবিতে গ্রিন ভয়েসের বৃক্ষরোপণ ও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন

মার্কিন বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানে রুশ হামলা

মালয়েশিয়ার পর চীন সফরে যাবেন নাহিদ

৩১ দফাই হচ্ছে আমাদের জাতীয় সনদ : সুব্রত চৌধুরী

১০

টিসিবির নিয়ন্ত্রণ হারানো ট্রাকচাপায় বৃদ্ধ নিহত

১১

ইতালির প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর বাতিল

১২

জেলেনস্কির টার্গেট তুরস্ক, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড

১৩

শিক্ষকের ওপর হামলা, ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ

১৪

‘আপনাকে গভীরভাবে অনুভব করি প্রতি পদে পদে’

১৫

এইচএসসির ফল প্রকাশের তারিখ নিয়ে প্রচার, শিক্ষা বোর্ডের বক্তব্য

১৬

হাসারাঙ্গাকে ছাড়াই শ্রীলঙ্কা দল ঘোষণা

১৭

ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের টাকা নিয়ে উধাও সমাজসেবা কর্মকর্তা

১৮

সিলেটে সাদাপাথর লুট / গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বিমত

১৯

আমাদের আদর্শগত শত্রু বিজেপি, বললেন থালাপতি বিজয়

২০
X