মাঠ প্রশাসন বিশেষ করে লোকাল প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা নতুন নয়। শুধু তাই নয়, একের পর এক এসব ঘটনায় জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির দৃষ্টান্তও নেই। বলা বাহুল্য, অপরাধী যেই হোক, উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না করা বা প্রকৃত জবাবদিহির চর্চা সৃষ্টি সম্ভব হয়নি বলেই প্রশাসনে বারবার এ হীন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে। এটা অত্যন্ত হতাশার চিত্র।
রোববার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত ‘এক যুগে ৮ ডিসির কেলেঙ্কারি, নজির নেই বড় শাস্তির’ প্রতিবেদনে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নতুন করে এ আলোচনার জন্ম হয়েছে শরীয়তপুর জেলার ডিসির নারী কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে। শুধু নারী কেলেঙ্কারি নয়, আলোচনাটির জন্ম হয়েছে মূলত প্রশাসনের লোকের এ গর্হিত অপরাধের পরও তার বিরুদ্ধে প্রকৃত আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য।
প্রতিবেদন অনুসারে, দুই নারীর সঙ্গে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের আপত্তিকর দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে শনিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এমন একটি অপরাধের কারণে ওই কর্মকর্তার ওএসডির মতো লঘু শাস্তিই জন্ম দিয়েছে পুরোনো আলোচনার, যা তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এর আগেও বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, এক যুগে আটজন ডিসি যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও উঠেছে একই অভিযোগ। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এসব অভিযোগ কম নয়। কিন্তু এসব ঘটনায় নজির সৃষ্টি হওয়ার মতো শাস্তি দেয়নি সরকার। নানা কায়দা-কৌশলে পার পেয়ে যান অপরাধী কর্মকর্তারা। স্বাভাবিকভাবেই অপরাধ-অনাচার বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন আরও বাড়ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন উঠছে, এত বড় অপরাধ করেও শাস্তি কেবল ওএসডি?
এটা গভীর হতাশা ও পরিতাপের বিষয় যে, প্রশাসন যেখানে অঙ্গীকার বা শপথ করে দেশের কল্যাণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, সেই প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয়দেরই যদি নৈতিকতার স্খলন এমন পর্যায়ে পৌঁছে, তাহলে সমাজে কী ধরনের বার্তা যাবে, তা ভাবতেই আমরা শঙ্কিত হই। আমাদের সমাজে এমনিতেই সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন তলানির দিকে। সমাজে নারীর প্রতি সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো ইতিবাচক জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। এ ছাড়া ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়নের চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। দায়িত্বশীল প্রশাসকরা যেখানে এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন, এমনকি নিজেদের চরিত্রকে এমনভাবে গঠন করবেন যেন অন্যদের প্রভাবিত করে, সেই তারাই যদি নৈতিকতার প্রশ্নে পাস করতে না পারেন, তাহলে সমাজ এগোবে কীভাবে?
এই তো গেল নৈতিকতার প্রশ্ন। আর নৈতিকতা রক্ষিত হবে যে আইন ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতার মাধ্যমে, সেখানেও যদি থাকে এই দুর্বল চিত্র অর্থাৎ জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে, তাহলে এ অবক্ষয় ঠেকাবে কে? প্রশাসনে জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি হবে কীভাবে?
আমরা মনে করি, প্রশাসনে যৌন কেলেঙ্কারির পুনরাবৃত্তি নৈতিক অবক্ষয় তো বটেই; আইনের শাসন ও জবাবদিহির চর্চা না থাকাই সাক্ষ্য দেয়। কেননা, এসব অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি শাস্তির কোনো উদাহরণ নেই। বড় বড় কর্মকর্তা বলে অনিয়ম-অনৈতিকতা করে পার পেয়ে গেলে তো এমনটা বারবার হবেই। আমাদের বিশ্বাস, প্রশাসনে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা কমানো সম্ভব।
মন্তব্য করুন