বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ৬ ভাদ্র ১৪৩২
প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শির ঘুম নাই

যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শির ঘুম নাই

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখন দোরগোড়ায়। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে হিসেবে নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চার মাস। নভেম্বরে ঘোষিত হবে নির্বাচনের তপশিল। বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। কিন্তু গত দুটি নির্বাচন সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে, সে উৎসবের আমেজে ভাটা পড়েছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ব্যস্ত সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দাবিতে অনড়। দুই দলের অনড় অবস্থানে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে নির্বাচন। অথচ চার মাস বাকি থাকতে এখন সারা দেশ নির্বাচনী আমেজে মেতে ওঠার কথা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যস্ত থাকার কথা অনানুষ্ঠানিক প্রচারণায়। কিন্তু তেমন আমেজ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সব রাজনৈতিক দল মুখে জনগণের কথা বললেও কার্যত জনগণের ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বিদেশিদের মাথাব্যথা বেশি। বাংলাদেশের মানুষের এখন একটা আকাঙ্ক্ষা—একটা অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যাতে মানুষ তাদের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারে এবং পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু বিএনপি যেভাবে সরকার পতনের একদফায় অনড়, তাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভব না কমে আসছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। তিনি ভুল বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন হয় দলীয় ভিত্তিতে। তাই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বড় দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটাও জরুরি। তার জন্য চাই দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা-সমঝোতা। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে সমঝোতার সম্ভাবনা ফুরিয়ে যাবে। তাই তপশিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে। অংশগ্রহণমূলক করা গেলে তারপরের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। সমস্যা হলো, আলোচনা-সমঝোতার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দুই দলের দাবির মধ্যে ব্যবধান এত বেশি, মেলানোর সুযোগ খুব কম। সুযোগ যত কমই হোক, মেলাতে হলে আলোচনায় বসতে হবে। কিন্তু আলোচনার ব্যাপারে কারোর আগ্রহ নেই। বিএনপি বলছে, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ছাড়া কোনো আলোচনা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার পদত্যাগ করলে আলোচনাটা কার সঙ্গে হবে? সরকারি দল আলোচনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না।

কেউ যদি আলোচনায় বসতে না চান, তাহলে সমাধান হবে কীভাবে? আরও একটি নির্বাচন বর্জন বা বয়কট বা প্রতিহত করার সামর্থ্য বিএনপির আছে কি না, সেই প্রশ্ন যেমন আছে আবার বিএনপিকে আস্থায় না নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে আরও একটি নির্বাচন করা সম্ভব কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও। দুই দলের এ অনড় অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সবাই অপেক্ষা করছে অন্য কিছুর জন্য। বিএনপি নামকাওয়াস্তে আন্দোলন করলেও এ আন্দোলনে যে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দাবি আদায় করা যাবে না, সেটা তারা ভালো করেই জানে। বিএনপি যেন অপেক্ষা করছে, কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।

মূল সমস্যাটা এখানেই। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশের চেয়ে বাইরের শক্তিগুলোর আগ্রহই বেশি। ভূরাজনৈতিক কারণে এমনিতেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত এক দশকের অর্থনৈতিক সাফল্যও বাংলাদেশের প্রতি অনেকের আগ্রহ বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে এখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নানা মেরূকরণ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান, জাপান, জার্মানি—সবারই আগ্রহের কেন্দ্রে যেন বাংলাদেশ। সবার চাওয়া আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়। এ চাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাও সমান্তরাল। এমনকি সরকারও অন্তত মুখে বলছে, তারাও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, চায় সব দল তাতে অংশগ্রহণ করুক। সবার চাওয়া অভিন্ন, এখন কাজ হলো সেই চাওয়ার বাস্তবায়ন। সমস্যা হলো, বিএনপি মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের সবার মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচন থাকলেও, কারও মুখেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে নেই। বাংলাদেশের মতো অন্য কোনো দেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এত অবিশ্বাস, সন্দেহ নেই।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব নয়, তবে সেটা নিশ্চিত করতে সবার কঠোর মনিটরিং দরকার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তারা বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। যদি আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে আশা করি সব দলের অংশগ্রহণ করতে আপত্তি থাকবে না।

কিন্তু কেউ যেন বাংলাদেশের জনগণের ওপর ভরসা করছে না। সবাই তাকিয়ে আছে বিদেশিদের দিকে। কখনো ওয়াশিংটন, কখনো দিল্লি হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদল দিল্লি ঘুরে এসেছে। নিশ্চয়ই তারা সেখানে আনন্দভ্রমণে যায়নি। সেখানে নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচন নিয়েই কথা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কড়া অবস্থান নিয়েছে। র‌্যাবের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তো আগেই ছিল। নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভিসা নীতি। তবে বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ভারতের শঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র বেশি চাপ দিলে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে—যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই।

ওয়াশিংটন, দিল্লি ঘুরে সবার নজর এখন সিঙ্গাপুরের দিকে। একদফা আন্দোলন যখন তুঙ্গে থাকার কথা, তখন বিএনপির তিন শীর্ষ নেতা এখন সিঙ্গাপুরে। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অনেক দিন ধরেই চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। কদিন আগে সেখানে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। বিএনপির মাঝারি সারির কয়েকজন নেতাও গেছেন সিঙ্গাপুরে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রয়েছেন ব্যাংককে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও গেছেন সিঙ্গাপুরে। সবাই চিকিৎসাকেই কারণ হিসেবে সামনে এনেছেন। সব শীর্ষ নেতার একসঙ্গে অসুস্থ হওয়াটা ঠিক কাকতালীয় মনে করার কারণ নেই। বলা হচ্ছে, সিঙ্গাপুরে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক হতে পারে। সিঙ্গাপুর থেকে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক হতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমানকে রাজনীতির মাঠে সামনে আনাও বিএনপি নেতাদের সিঙ্গাপুর মিশনের অন্যতম লক্ষ্য। অনেক দিন ধরেই সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির আগামী নেতা কে? আদালতের দণ্ড পাওয়ায় আগে থেকেই নির্বাচনে অযোগ্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। সম্প্রতি এক মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমানও নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছেন। তাই শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি নির্বাচনে আসেও, কে হবেন তাদের নেতা; এ প্রশ্নটি একেবারে অমূলক নয়। কারণ বাংলাদেশে দুই শীর্ষ দলই পরিবারকেন্দ্রিক। তাই আগামী নির্বাচনে জিয়া পরিবারের কে থাকবেন সামনে, এটা নিয়ে কৌতূহল ছিলই। সে কারণেই বিএনপি শর্মিলা রহমানকে সামনে আনতে চাইছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নিজেদের ঘরের ঝগড়া নিজেরা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো। বাংলাদেশের নির্বাচনের সিদ্ধান্ত যদি বাংলাদেশেই হতো, তাহলেই সবচেয়ে ভালো। ওয়াশিংটন নয়, দিল্লি নয়, সিঙ্গাপুর নয়; ঢাকাই যদি হতো সব আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্র; তাহলেই আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই প্রশ্নটা আমাদের মর্যাদারও। রাজনীতিবিদরা এ মর্যাদার বিষয়টা

বুঝলেই মঙ্গল।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

স্পেনে রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে অদ্ভুত বিতর্ক

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন আবু তাহের

মানবিক ড্রাইভার গড়তে নারায়ণগঞ্জে ডিসির যুগান্তকারী উদ্যোগ

গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত

পিএসসি সদস্য হলেন অধ্যাপক শাহীন চৌধুরী

রিয়ালের হয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টিনার ‘মাস্তান’

দাম্পত্য কলহ এড়ানোর সহজ ৫ উপায়

‘গণতন্ত্রের জন্য আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে’

আর্থিক খাত নিয়ে খারাপ খবর দিলেন গভর্নর

১০

পৌরসভার ফাইল নিয়ে দুই কর্মকর্তার হাতাহাতি

১১

কর্মস্থলে ‘অনুপস্থিত’, এবার পুলিশের ২ এসপি বরখাস্ত

১২

এশিয়া কাপ দল নিয়ে তোপের মুখে বিসিসিআই

১৩

নারী-শিশুসহ ছয় ভারতীয় নাগরিক আটক

১৪

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার : উপদেষ্টা আসিফ

১৫

পিয়াইন নদীতে অবাধে বালু লুট, হুমকিতে বসতবাড়ি 

১৬

সোনালী ও জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের ফল প্রকাশ

১৭

নরসিংদীতে একজনকে কুপিয়ে হত্যা

১৮

হোয়াটসঅ্যাপে নতুন কৌশলে অর্থ চুরি, যেভাবে নিরাপদ থাকবেন

১৯

টিটিইসহ ৫ জন আসামি / তিন মাসেও শেষ হয়নি ট্রেন থেকে ফেলে হত্যার তদন্ত

২০
X