প্রতি বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়, তখন বাংলাদেশের আকাশে যেন দুটো ভিন্ন আবহ দেখা দেয়—একদিকে বরণ করা হয় গর্বিত বিজয়ী মুখ আর অন্যদিকে নিভে যায় কিছু স্বপ্নের আলো। সেদিন শুধু রেজাল্ট বের হয় না, বরং বের হয়ে পড়ে সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা—একটা কাগজের নাম্বার দিয়ে একজন কিশোর-কিশোরীর জীবনের ‘মান’ নির্ধারণ করা হয়। অথচ, শিক্ষা শুধু সনদের নাম নয়—এটা ভাবনা, দক্ষতা, স্বপ্ন আর লড়াইয়ের গল্প। আমরা ভুলে যাই, পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষরাও একাধিকবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি। তাহলে আজকের একজন শিক্ষার্থী যদি কিছু নম্বরে পিছিয়ে যায়, তাতেই কি তার জীবনের গন্তব্য হারিয়ে যাবে?
বাংলাদেশের এসএসসির ফল এখন শুধু একাডেমিক সনদের বিষয় নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মসম্মানের যুদ্ধ, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা। অথচ বাস্তবতা হলো—একটি ফলাফল কখনোই কারও প্রতিভার শেষ বিচার হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী হয়তো অঙ্কে দুর্বল, কিন্তু সে হয়তো একদিন দারুণ একজন সাহিত্যিক হবে। কারও জিপিএ ৫ নেই বলেই তার জীবনে আলো থাকবে না—এমন ভাবনার কোনো যুক্তি নেই। পৃথিবীতে কেউ প্লেন আবিষ্কার করেছে, কেউ সফটওয়্যার—তাদের একাডেমিক ফলের চেয়ে বড় ছিল তাদের কল্পনা, অধ্যবসায় ও মানসিক দৃঢ়তা।
ফল প্রকাশের দিনগুলোতে আমাদের দেশে শুধু সফলদের নিয়েই আলোচনা হয় আর যাদের রেজাল্ট খারাপ হয়, তারা যেন সমাজের বাতিল হয়ে যায়! এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে ব্যর্থদের পাশে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি নেই?
বিশ্বের অনেক সফল মানুষের জীবন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—ফল নয়, বরং লক্ষ্যপূরণের জেদই একজন মানুষকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছায়।
এসএসসি পরীক্ষার ফল জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ, বিশাল জীবনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। চীনের উদ্যোক্তা জ্যাক মা জীবনের প্রথম দিকেই ৩০টিরও বেশি চাকরির আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কেএফসিতে ওয়েটার পদে পর্যন্ত তাকে নেয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাতেও তিনবার ফেল করেছিলেন। কিন্তু তিনিই পরে গড়ে তুলেছেন আলিবাবা, যেটি এখন বিশ্বের অন্যতম বড় ই-কমার্স সাম্রাজ্য। স্টিভ জবস স্কুলের গণ্ডিতে খুব একটা উজ্জ্বল ছিলেন না, কলেজ থেকেও ঝরে পড়েন। কিন্তু পরে তিনি প্রযুক্তি জগতের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এ মানুষগুলো আমাদের শেখায়—ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং সাফল্যের একটা ভিন্ন শুরু। চার্লস ডারউইনের কথাই ধরা যাক। তার বাবা ভেবেছিলেন, এই ছেলেটা জীবনে কিছুই করতে পারবে না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে মাঝপথেই ছেড়ে দেন তিনি। অথচ পরবর্তীকালে তিনিই বিশ্ববিখ্যাত বিবর্তন তত্ত্বের জনক হন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ‘মিসাইলম্যান’ এপিজে আবদুল কালাম ছোটবেলায় সংবাদপত্র বিলি করতেন। তার পরিবারের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। স্কুলজীবনে অনেকেই তাকে গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু অধ্যবসায় আর স্বপ্নের শক্তিতে তিনি শুধু বৈজ্ঞানিক নন, কোটি তরুণের অনুপ্রেরণায় পরিণত হন। এমনকি আইনস্টাইনকেও স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন, ‘এই ছেলে কিছু করতে পারবে না’—তিনি তো অঙ্কেও নাকি দুর্বল ছিলেন। অথচ আজ সেই নামটাই বিজ্ঞানের প্রতীক। চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ—সবখানেই ব্যর্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। আর আমরা? একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার জীবনকে শেষ বলে মনে করি! এই মনোভাব এখনই বদলাতে হবে। প্রতিটি এসএসসি পরীক্ষার্থী—সে সফল হোক কিংবা অকৃতকার্য, তাকে মনে রাখতে হবে—এটাই শেষ নয়। জীবনটা অনেক বড়। এসএসসি কেবল একটি স্টেশন মাত্র, গন্তব্য নয়। যদি ট্রেন মিসও হয়, পরবর্তী ট্রেনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র—সবাইকে এদের পাশে থাকতে হবে। কারণ, সঠিক সময়ে একটি সহানুভূতির হাত হয়তো একটা জীবন রক্ষা করতে পারে।
পরীক্ষায় ফেল করা মানেই জীবন ফেল নয়। এসএসসি রেজাল্টের আগে একজন শিক্ষার্থী ছিল সন্তান, বন্ধু, ভাইবোন এবং তার ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে পরবর্তী চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস আর মানসিক দৃঢ়তার মাধ্যমে। আমরা যদি সত্যিই শিক্ষিত হই, তাহলে আমাদের উচিত সেই ব্যর্থতার মুহূর্তে একজন শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো, তার হাত শক্ত করে ধরা—জয়ী হওয়ার নতুন গল্প শুরু করার জন্য।
ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট
মন্তব্য করুন