বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৫৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে দেশে ঘুষের কেরামতি

দেশে দেশে ঘুষের কেরামতি

সম্ভবত ঘুষ জিনিসটা আমাদের সমাজে বহু আগ থেকে প্রচলিত ছিল। তবে তা টাকার অঙ্কে গ্রহণ ও প্রদানের ব্যাপকতা বাড়ে ইংরেজ শাসনামলে। আগে ক্ষমতাবান, ক্ষমতা আশ্রিত বা করুণা বিতরণে সামর্থ্যদের মন জয়ের জন্য পুকুরের বড় মাছ, আম, কাঁঠাল, কলা, মুলা, লাই, মুরগি ও কবুতর ইত্যাদি ভেট দেওয়া হতো। নিজ চোখেই এসব নিয়ে ছোটাছুটির দৃশ্য দেখেছি। এখনো এসব প্রচলন একেবারে উঠে গেছে তা বলা যাবে না; রূপান্তর ও ব্যাপকতা বেড়েছে মাত্র। তখনকার ভেট, নজরানা, উপহার, উপঢৌকন হয়তো কমবেশি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ছিল। একসময়ে নাইজেরিয়ার বায়েরো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছি। শিক্ষকরা নন, নামাজ-রোজায় পটু কর্মকর্তাদের দেখেছি মদপানে চুর আর ঘুষ গ্রহণে উন্মুখ। মদপান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আশ্চর্যজনক ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম। তাদের মতে, ‘আমরা যেমন মুসলিম, তেমনি আফ্রিকানও বটে। তাই নামাজ-রোজাকারী ঠিকই; আফ্রিকান হিসেবে বহু বিয়ে করি, মদপান করি এবং আমির-ওবাদের পদের মতো পদে অধিষ্ঠিত আছি বলে সে পদের মর্যাদা ও সৌজন্যে ঘুষও নিয়ে থাকি। ঘুষ না দিলে তোমার কোনো কাজই হবে না, নগদে দিতে পারো কিংবা কয়েক বোতল মদ নিয়ে আসো।’ আমার এক আত্মীয় ঘুষ না দিয়ে তার বিষকল ভোগ করেছিলেন। তিনি রেসিডেন্ট মেডিকেল পদে নিয়োজিত হয়ে শেষে সামান্য মেডিকেল অফিসার পদে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইউরোপিয়ানদের দেখেছি নিজ দেশে সাধু-সজ্জন, তবে নিজের দেশের বিমানবন্দরটি পার হওয়ার পর তারা সবাই মিস্টার হাইড। তবে এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুর ব্যতিক্রম। আমাদের দেশে কলামুলাটা দেওয়ার রেওয়াজ সর্বব্যাপী। ঘুষ দিয়ে চাকরি মেলে, প্রমোশন মেলে, নমিনেশন মেলে, এমনকি মন্ত্রিত্বও মেলে। দলের নেতৃত্বও ঘুষ দিয়ে নিশ্চিত করা যায়। আরও কত কী শুনছি। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা বা নৈতিকতা কোনো কাজে আসে না। অতীতে সরকারি কিংবা বেসরকারি অফিসের নিম্ন বেতনভুক্তদের ঘুষ বা বকশিশ দিতেই হতো, পরিমাণ কম হলেও বিনিময়ে সেবাটা পাওয়া যেত। হয়তো অভাবী হয়েই তারা হাত পাতত। দিন বদলে গেছে। শুনেছি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল এগিয়ে দিতে ঘুষ দিতে হয়। না দিলে ফাইলের গতি কমে যায় বা ফাইল হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ফাইল উদ্ধারে কয়েকগুণ বেশি বকশিশ দিতে হয়ে। এখন শুনেছি যে ঘুষের হারটা বেশি হওয়ার কারণ তারা তাদের ঊর্ধ্বতনদের ঘুষের একটা অংশ দিয়ে থাকে। আমি সব জায়গার কথা বলতে পারি না। জীবনে একটা ব্যতিক্রম দেখেছি। বিনা ভেটে আমার বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছিলাম একজনের সৌজন্যে। সম্প্রতি তার সন্ধান পেয়েছি। এমন লোক আজকাল বিরল। এখন আমার কাজের জন্য মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করে থাকি। ঘুষের কত শতাংশ তারা নেয় আর কত শতাংশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নেন তা নির্ণয় করা কঠিন। পরিমাণ নিয়েও রকমফের আছে; আপন লোক দিয়ে কাজ করাতে যেখানে ২ হাজার টাকা লাগে, বাইরের দালালরা নেয় ২০ হাজার টাকা। আমার লোকেরাও দেখে দেখে শিখে নিয়েছে তাদের হারও বেড়ে গেছে।

ঘুষ আমাদের সমাজে অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। বিয়ের আগে চাকরিতে হবু জামাই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হতো—‘জামাই কত টাকা বেতন পায়? উপরি কত টাকা পায়?’ উপরি টাকার প্রান্তিক উপযোগ অনেক বেশি। তার পরিমাণ দিয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে। বুঝতে পারছেন আমাদের সমাজে ঘুষজাতীয় দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা বা প্রতিরোধ তেমন নেই। এখানে ধর্ম-বর্ণ-কর্মের পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। আমাদের পাড়ায় কেরানি জাতীয় ব্যক্তিদের পেট ঊর্ধ্বগামী ছিল। অনেকেই বলত ঘুষ খেলে পেট বড় হয়। তারা যে ঘুষ খেত তার প্রমাণও পাওয়া যেত। আরও বলা হতো ঘুষখোরের সন্তানাদি মানুষ হয় না। ফলাফল কিছু দেখেছিলাম। এখন দেখছি মনে হয় স্রষ্টাও ঘুষখোরদের পক্ষে। তাদের সন্তানাদি উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে, বিদেশে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হচ্ছে। তবুও তাদের পেট ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত। মৃত্যুর ভয় মৌলবি-মাওলানারা দেখাত কিন্তু আজ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররমের কোনো খতিবকে ঘুষ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে শুনিনি। মনে হয় কালো জাহাঙ্গীররা সমাজে পূজনীয়। কালো জাহাঙ্গীর আমার পাশের গ্রামের বাসিন্দা ছিল। একবার জাকাতস্বরূপ সে ৭০ লাখ টাকা দিয়েছিল। গ্রামের মানুষ আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, ‘জাহাঙ্গীর হতে তোমার সারাজীবন লাগবে।’ আমি গ্রামে যেতে ভয় পাই; মানুষ বকশিশ পেয়ে এতটা অভ্যস্ত যে, তারা আমাকেও একমুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দেয় না।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অতীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নাক সিটকানো দেখেছি। কিছুদিন ভালো দিন গেল। আবার সে ধারা দৃশ্যমান, আবার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানাদি বা ভেকধারি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে ঘুষখোরদের বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনিদের কিছু কথা বলছি। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরিদের পুরস্কৃত করছে। ভারতে প্রদত্ত বৃত্তিও তার একটি। তবে যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তাদের চলনে-বলনে পোশাক-আশাক মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শিক্ষা নিয়ে প্রত্যাবর্তনের পর তারা দারুণ ভারতবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হয়ে যায়; হয়তো তারা আগেও তেমন ছিলেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে পায়, সেখানে ল্যাং মারে। বিভিন্ন অফিস-আদালতে যাই, আগে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতাম। কাজ কিছু হয়েছে আগে। এখন চিত্র ভিন্ন। ঠেকে শিখেছি, কাজ আটকে যায় প্রতি স্তরে, ঘুষ দিতে পারি না বলে কাজ আর হয় না। অথচ সেসব অফিসার লাজশরমে আমাদের কাজে হাত পাতেন না, কিন্তু জামায়াত-বিএনপির কাজ থেকে বখরা পেয়ে ঠিকই সব কাজ করে দেন। সরকারের কিছু সতর্কতা সত্ত্বেও অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তারা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে প্রচুর পুঁথিগত জ্ঞান নিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ সাঈদীর মৃত্যুতেও সরবে শোক জানিয়ে থাকতে পারেন। সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানানো ৩০০ ব্যক্তিকে আসাদুজ্জামান তার ফেসবুক থেকে মুছে দিয়েছেন। ছাত্রলীগ প্রায় ২৫০ জনকে স্থানচ্যুত করেছে, ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে কি না জানি না। ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হলো কিন্তু আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগসহ ইত্যাকার সংগঠনের নেতা-নেত্রীর শুভদৃষ্টিতে রয়ে গেল। তারা দলে গ্রুপিং বা আসন্ন নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। টেবিল যদি কোনো কারণে উল্টে যায়; তাহলে একবার তাদের নির্মূলে যারা নেমেছিল, তারাই প্রথম নির্মূল হবে। ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভালোই ধরে ফেলেছেন। ঘাতক বা তাদের উত্তরসূরিরা ছদ্মবেশে আমাদের পাশেই আছে। তাই প্রথম সুযোগেই সব সাফ করার ক্ষমতাও কৌশল তাদের আছে। আমার মতো যারা এসব কথা বলেন তারা শক্তিমানদের বিরাগভাজন হন, উপকার বঞ্চিত হন, কটুকথা শোনেন, বাড়িতে ঢিল পড়ে, সমাজচ্যুত হন, মামলায় জড়িয়ে যান, কখনো মারধর বা হত্যার শিকার হন। তাই তাদের সংখ্যা কম। কার ঘাড়ে কয়টি কথা আছে যে প্রতিবাদ করবে?

বাংলাদেশে কেন সারা বিশ্বে ঘুষের উৎসব। উপরির প্রচণ্ডতা ও প্রখরতা বেশি। এখানে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই উপকারভোগী। তাই অভিযোগকারী বা অভিযোগ গ্রহীতা পাওয়া দুষ্কর। যদিও পাওয়া দায়, তখন সেসব দমনে নিয়োজিতরা সরিষাতেও ভূত দেখেন। একসময় সমাজতন্ত্র দিয়ে তার প্রতিবিধানের চেষ্টা হয়েছিল। এখন তথ্যপ্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগে কিছুটা আশার আলো ও স্বপ্ন সারা বিশ্ব করতে শুরু করেছে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভর্সিটি অব বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

একই দিনে দুইবার পরিবর্তন, রাকসু নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ

পারকি সৈকতের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ

১০

জয়পুরহাটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুর্ধর্ষ চুরি

১১

হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের নামে প্রতারণা, সতর্ক থাকার নির্দেশ

১২

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের প্রচারণার ভিডিওতে থাকায় বিপাকে শেবাগ

১৩

ভারতের ছাড়া পানি থেকে বাঁচতেই বাঁধ উড়িয়ে দিল পাকিস্তান!

১৪

সিলেটে পানির জন্য হাহাকার, সড়ক অবরোধ

১৫

অপারেশনের পর জ্ঞান না ফেরায় রোগীর মৃত্যু

১৬

শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজারে ওরস বৃহস্পতিবার

১৭

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পুলিশ ‘ক্ষমা’ চাইবে, জানালেন ফাওজুল কবির

১৮

নদীভাঙন এলাকা পরিদর্শনে গেলেন উপদেষ্টা শারমিন মোরশেদ

১৯

বাবরকে নিয়ে মন্তব্য করায় হারিসকে লাঠি দিয়ে মারতে চান সাবেক পাক ক্রিকেটার

২০
X