অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিপৎকালীন ঐক্যই হোক শক্তি

বিপৎকালীন ঐক্যই হোক শক্তি

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপের নাম বিগ আইল্যান্ড। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ও সোনালি কচ্ছপ দেখার জন্য গিয়েছিলাম। রাজধানী হনলুলু থেকে এক ঘণ্টার বিমান যাত্রা। যাওয়ার সময় নিচে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি দেখে চমৎকার লাগছিল। কিন্তু আসার সময় বদলে গিয়েছিল সবকিছু। এক ঘণ্টার ফ্লাইটে জুশ আর বাদাম ছাড়া আর কিছু দেওয়া হয় না। সেটা দিতে এসেছিলেন বিমানসেবিকা। হঠাৎ বিমান এমন দুলুনিতে পড়ল যে, মনে হচ্ছিল ছিটকে পড়ে যাবে নিচে। জুশ-বাদাম চারদিকে সব ছড়িয়ে পড়ল। বিমানসেবিকা ভদ্রমহিলা নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন দুই সিটের মাঝখানে। আমাদের তো তখন হয়ে গেছে! ভাবছিলাম আমি আর দীপা দুজনই চলে গেলে আমাদের ছেলেটি তো পৃথিবীতে একেবারে একা হয়ে যাবে। ঈশ্বরকে, মাকে স্মরণ করতে করতে আমাদের সময় যেন ফুরাতে চাইছিল না। নিচে তাকিয়ে দেখলাম সেই নীল জলরাশি।

হনলুলু থেকে বিগ আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে যে জলরাশি ছিল স্নিগ্ধ-প্রশান্ত, ফেরার এই দুর্যোগকালে তাকে মনে হচ্ছিল ফণা তোলা রুদ্র সাপের মতো। পাইলট যদি বাগে রাখতে না পারতেন, তাহলে সেদিনই হতো আমাদের শেষ যাত্রা। বিমান দুর্ঘটনা বলে-কয়ে হয় না। আর হলে বাঁচার চান্স জিরো। রকমভেদে বিমান ভূপাতিত হওয়ার নানা কারণ থাকে। আমি বলছি ঢাকার মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির কথা। সামলাতে না পারা বিকল যুদ্ধবিমানটি এসে আছড়ে পড়েছিল স্কুল/কলেজ ভবনে। সে ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। ঘটনার তিন দিন পর স্কুলের এক ছাত্রের কথা তুলে ধরছি—রামিম তাসকিন আহমেদ স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন বিমান বিধ্বস্তের পর বিস্ফোরণের ফলে লাগা আগুনের আঁচে তার এক কান পুড়ে যায়। শরীরের সেই পোড়া ক্ষত ছাপিয়ে বন্ধু হারানোর বেদনায় কাতর এ শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে দেখা হয় স্কুলের চার নম্বর ভবনের সামনে। রামিম এসেছিল ঘটনার দিন রেখে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে বলছিল, ‘আমাদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে সবাইকে বের করে দেওয়ার পরই আমি বের হই। তখনো তাই করছিলাম। খুব বেশিজন তখন সেখানে ছিল না। ছুটির পর যারা কোচিং করে এরকম চার-পাঁচজন ছিল। এমন সময় টিনের ওপর আমরা একটা শব্দ শুনতে পাই। এরপর আরও একটা বিকট শব্দ। তৃতীয় ধাপে হয় এর চেয়েও বিকট শব্দ। দ্বিতীয় শব্দের পর মিনিটখানেক কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। তৃতীয় শব্দের সঙ্গেই আগুন লেগে যায়। আমি দূরে ছিলাম, সেই আগুনের আঁচেই আমার কান পুড়ে গেছে। চোখের সামনেই আমার তিন বন্ধু পুড়ে মারা গেল। সেই দৃশ্য আর মনে করতে চাই না!’

রামিমের পাশে থাকা তার বাবা রুবেল আহমেদ সন্তানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ও ভীষণ ট্রমার (আতঙ্কে) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। আমরা ওকে ঘটনার দিন থেকে একা থাকতে দিচ্ছি না।’

রামিমের সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থী এসেছিল ক্যাম্পাসে। তার নাম জাহিদ মোল্লা। জাহিদ মাইলস্টোনের বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেও বাবার সঙ্গে রেখে যাওয়া বই-খাতা ও সাইকেল নিতে এসেছিল। জাহিদ জানায় তার বেঁচে ফেরার গল্প। তার মতে, সেটা অলৌকিক। কারণ প্রতিদিন ছুটির সময় ঠিক সেই জায়গাটায় গিয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে, যেখানে গত সোমবার (২১ জুলাই) বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আতঙ্কভরা অভিব্যক্তি নিয়ে জাহিদ বলে, ‘প্রতিদিনের মতো আমি ঠিক ওই জায়গাতেই অপেক্ষা করছিলাম। এক বন্ধু এসে আমাকে বলল, চল ক্যান্টিনে যাই। আমিও কিছু না ভেবে ওর সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলাম। রওনা দেওয়ার বিশ-পঁচিশ সেকেন্ডের মাথায় বিমানটি এসে ওখানে পড়ে। আমি যে বেঁচে ফিরেছি, এটা এখনো বিশ্বাস হয় না।’

এই অবিশ্বাস্য বেঁচে ফেরার গল্পগুলো আমাদের দুটি শিক্ষা দেয়—

এক. বিপদে মিথ্যা ও গুজব না ছড়ানোর।

দুই. লাশ বা আহতদের নিয়ে রাজনীতি না করা।

কিন্তু আমরা তা মানি না। আপনি দেশ-বিদেশে এমন দুর্ঘটনার অনেক খবর দেখবেন। উন্নত দেশ হলে তো এতদিনে মন্ত্রীর পদত্যাগ; এমনকি সরকারেরও বারোটা বাজার কথা। কে জেলে যেত আর কে বাইরে থাকত বলা মুশকিল। আমাদের আশপাশে যেসব গণতান্ত্রিক দেশ আছে, তাদের দিকে তাকালেও দেখবেন হয়তো কিছু বিষয় চাপা পড়ে যায়, হয়তো সর্বৈব সত্য বের হয়ে আসে না, কিন্তু মোটামুটি একটা ছবি পাওয়া যায়। সে তথ্য বা ছবিতে বিশ্বাস রাখা চলে। কিন্তু আমাদের সমাজে তার বালাই নেই।

আজকাল চাইলেও সত্য বলা মুশকিল। বলা গেলেও তার দায়িত্ব নেয় না কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মানুষ মৃতের সংখ্যা আহতের পরিমাণ নিয়ে নানা অভিযোগ করছে? কেন বাচ্চাদের আবার মাঠে নেমে মার খেতে হয়? এসব স্পষ্ট হওয়া উচিত, স্পষ্ট করা উচিত। কী এক আজব সমাজ! কদিন আগে যেসব বাচ্চা এদের দেশ শাসনে আনার জন্য জান দিল, তারাই এখন লাঠির শিকার।

মানুষ আরও বেশি বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে রাজনৈতিক দল ও সিনিয়র নেতাদের দন্তবিকশিত সমঝোতার মিটিং দেখে। তখন কিন্তু দেশ-বিদেশে বাংলাদেশিদের চোখে কান্না। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ছিল বাঙালির আকাশ। সেখানে হঠাৎ এমন মিটিং আর খুশি খুশি ভাবের ফটোসেশন দায়িত্ববোধের অভাব তুলে ধরেছে। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায়? তরুণ ও নতুন প্রজন্মের ওপর যেসব দায় ও আগাছা আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি, তারা কি এর থেকে মাথা তুলতে পারবে?

সব নেগেটিভেও কোনো না কোনো পজিটিভ কিছু থাকে। এ দুর্ঘটনার পর জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। রক্তদান থেকে চোখের পানিতে ঐক্য গড়ে উঠেছিল বাঙালির। এই আমাদের শক্তি। অন্তত বিপদের সময় এই যে ঐক্যবোধ, তার ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছড়াকার ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার কাজী মনিরুজ্জামান বরখাস্ত

ইরানের মৃত পরমাণু বিজ্ঞানীরা হেঁটে বেড়াচ্ছেন : ইসরায়েল

আটাবে প্রশাসক নিয়োগের প্রতিবাদে সাধারণ সদস্যদের বিক্ষোভ

বগুড়ায় দুদকের গণশুনানি মঞ্চে জুতা নিক্ষেপ

এস এম সুলতান : তুলির রেখায় গ্রামীণ মহাকাব্যের রূপকার

জাল রায় তৈরি  / জামিন মেলেনি খায়রুল হকের 

পিআর পদ্ধতি চালুর দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা জামায়াতে ইসলামীর 

ফের ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক

ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে ১৬ দল উত্তীর্ণ

৪০ হাজার টাকা বেতনে ভিভো-তে কাজের সুযোগ

১০

ঋতুপর্ণাদের পর এবার সাগরিকারাও খেলবে এশিয়ান কাপে

১১

সচিবালয় কর্মচারীদের পদের নাম পরিবর্তনে ৯ যৌক্তিকতা

১২

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে ‘প্রস্তুত হ রাজাকার’ লিখে হুমকি

১৩

যেসব আমলে দ্রুত বিয়ে হয়

১৪

ভিসা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে যাদের ১৫ হাজার ডলার লাগবে

১৫

দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কারের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব : সালাহউদ্দিন

১৬

হাসিনা-ইউনূস দ্বন্দ্বে আমি ‘বলির পাঁঠা’ হয়েছি : টিউলিপ

১৭

গাজীপুরে যেভাবে হানিট্র্যাপের শিকার হন যাত্রীরা

১৮

সিলেটে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৫ জন দগ্ধ

১৯

পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে নিশোর, শুটিং বন্ধ 

২০
X