মো. সবুজ মিয়া
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৫, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে

পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে

বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। এ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা, যা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার সুউচ্চ পর্বতমালা এবং সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলার টিলা অঞ্চল বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক চরিত্রকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর।

যার অধিকাংশই টারসিয়ারি যুগে হিমালয় পর্বত উত্থিত হওয়ার সময় সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ভাওয়াল ও মধুপুরের গড় ও উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু জায়গা জুড়ে ঘন অরণ্যের দেখা পাওয়া যায়। বন বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট ভূমির ৯.৩৩ শতাংশের অধিক প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জায়গা জুড়ে পাহাড়ি বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। একসময় এসব পাহাড়ই ছিল প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার অভয়ারণ্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের মূল কেন্দ্রস্থল। পাহাড়ি অঞ্চলের অরণ্য, ঝরনা, পশুপাখি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতির মিলনে গড়ে উঠেছে এক অনন্য জীবনব্যবস্থা। এখানে রয়েছে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর, উড়িআম, ঢাকিজাম, সিভিট, সেগুন, গামার, চম্পা, জারুল, বৈলামসহ অন্যান্য স্থানীয় বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার। এ ছাড়া পাহাড়ি বনাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ ও বেত জন্মে। হাতি, চিতাবাঘ, বন্যশূকর, হরিণ, বানর, উল্লুক, অজগর, উদয়ী পাকরা ধনেশ, বড় র‌্যাকেট ফিঙে, পাতি-ময়না, গলাফোলা ছাতারেসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির প্রধান আশ্রয়স্থল হলো পাহাড়। এ ছাড়া পাহাড়ে বসবাস করে চাকমা, মারমা, গারো, ওরাওঁ, বক, রাখাইন, ত্রিপুরাসহ অসংখ্য ছোট-বড় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।

পাহাড় শুধু প্রকৃতি নয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়েরও প্রতীক। আদিবাসীদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, নৃত্য, সংগীত ও ধর্মবিশ্বাসে এ পাহাড়ের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কালের বিবর্তনে এ জীবনব্যবস্থা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বন উজাড়, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, খনিজ আহরণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে পাহাড়ি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। অপ্রতুল পরিবেশ আইন, দুর্বল প্রশাসনিক নজরদারি এবং অর্থনৈতিক লোভ পাহাড়ি অঞ্চলকে করে তুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশবিধ্বংসী।

বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাবার বাগান, তামাক চাষ ও বিদেশি বিনিয়োগের নামে পাহাড়ি জমি দখলের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া পাহাড়ে পর্যটন ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত পাহাড় ও বনভূমি কেটে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও পর্যটন কেন্দ্র। এতে ভূমিহীন হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসকারী স্থানীয় মানুষরা। একদিকে বনভূমি কমছে; অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হারাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষ খুব জনপ্রিয়। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড় কেটে জুম চাষ ও বসতবাড়ি নির্মাণের ফলে প্রতি বছর বর্ষায় পাহাড় ধসের ঘটনাও বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া খনিজ আহরণ, শিল্পকারখানা স্থাপন, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণী হত্যার ফলে পাহাড়ি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

শুধু প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি নয়, পাহাড়ি অঞ্চলে সামাজিক বৈষম্য, অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্রও ভয়াবহ। পাহাড়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। শিশুদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চড়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থাও অপ্রতুল্য। উন্নয়ন কার্যক্রমে ঘাটতি, জাতিগত সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য অবজ্ঞা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণহীন উন্নয়ন পরিকল্পনা পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে চরম অসন্তোষ ও অবিশ্বাস। ফলে পাহাড়ে উন্নয়ন নয়, বরং একধরনের অব্যবস্থাপনা ও শোষণের চিত্রই স্পষ্ট হচ্ছে বারবার। অথচ চাইলে এ পাহাড়ই হতে পারে টেকসই উন্নয়নের অনন্য ক্ষেত্র। পর্যটন, কৃষি, বনসম্পদ ও সংস্কৃতি—এ চারটি ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পাহাড়ি জনগণের কল্যাণ এবং পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রয়োজন অবিলম্বে জাতীয় পর্যায়ে পাহাড় সংরক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, জমি দখল ও ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে পাহাড়ি সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা করতে হবে। পাহাড়ি প্রকৃতি ঝরনা, গাছ, প্রাণী আর মানুষের সহাবস্থান যেন অটুট থাকে—সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। পাহাড়কে শুধু অর্থনৈতিক মুনাফার উৎস হিসেবে না দেখে, এটি যেন আমাদের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের অংশ সে দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আমরা যদি এখনই পাহাড়ের প্রতি দায়িত্বশীল না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি মৃতপ্রায়, প্রাণহীন ও বিপর্যস্ত ভূখণ্ডই পাবে। তাই পাহাড়কে শুধু পাহাড় হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানবিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে একে রক্ষায় এগিয়ে আসা সময়ের দাবি।

মো. সবুজ মিয়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাদ্রাসায় চালু হলো নতুন সাবজেক্ট

মুরাদনগরে বিষাক্ত স্পিরিট পানে ২ জনের মৃত্যু

প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, থানায় মামলা

কুষ্টিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ভোমরারা হতাশ হয়েছেন : নুর

দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা

এবার চট্টগ্রামে সাংবাদিককে গলা টিপে হত্যাচেষ্টা

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব

এনসিপির হয়ে নির্বাচন করব কিনা সিদ্ধান্ত নেইনি : আসিফ মাহমুদ

সবাইকে টেস্ট খেলানো জরুরি নয় : জোরাজুরিতে দেউলিয়ার শঙ্কা

১০

প্রবাসেও আপ বাংলাদেশের কমিটি ঘোষণা 

১১

ইসরায়েল পুড়ছে রেকর্ড তাপমাত্রায়

১২

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সহায়তার চেক দিল যমুনা অয়েল

১৩

অসহায় পরিবারের দুই শিশুকে চিকিৎসা সহায়তা-অটোরিকশা দিলেন তারেক রহমান

১৪

৩০০ আসনে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে গণতন্ত্র মঞ্চ 

১৫

ড্রোন শো পরিচালনার প্রশিক্ষণে চীন যাচ্ছেন ১১ জন

১৬

সামাজিক কাজে অবদান রাখায় নিবন্ধন পেল প্রভাত

১৭

স্বাস্থ্যের ডিজির আশ্বাসে মন গলেনি, নতুন কর্মসূচি ছাত্র-জনতার

১৮

শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় পরে বস্তিবাসীদের অবস্থান

১৯

পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে : চরমোনাইর পীর

২০
X