কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গৃহবধূ থেকে গণতন্ত্রের মা

ড. মোহা. হাছানাত আলী
ড. মোহা. হাছানাত আলী। ছবি : সংগৃহীত
ড. মোহা. হাছানাত আলী। ছবি : সংগৃহীত

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া মূলত একজন গৃহবধূ ছিলেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকাটাকেই পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে কিছু উচ্চাভিলাসী বিপৎগামী সেনা কর্মকর্তার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করলে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য, বিএনপিকে সুসংগঠিত করাসহ দেশ ও জাতির কল্যাণ এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে বেগম জিয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পদার্পণ করতে হয়। রাজনীতিতে এসেই তাকে বহুবিদ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। বিপন্ন গণতন্ত্র উদ্ধারে তাকে দীর্ঘ নয়টি বছর রাজপথে লড়াই সংগ্রামে কাটাতে হয়। এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি আপসহীন নেত্রীর উপাধি লাভ করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তিনি ছিলেন অবিচল, রাজপথে ছিলেন সক্রিয়। কোনো লোভ লালসার কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি। বহু সিনিয়র সহকর্মী দল ত্যাগ করে গেলেও তিনি সামনের কাতারে থেকে দল এবং জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি না করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তিনি ছিলেন ইস্পাত কঠিন। স্বৈরাচার এরশাদের অধীনে অনেকে আঁতাত করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বেগম জিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণে রাজপথকেই এবং রাজপথের সংগ্রামী জনতার কাছে থাকাকেই বেছে নিয়েছেন। জুলুম আর অত্যাচারকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন।

পরবর্তী সময়ে বেগম জিয়ার আপসহীন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটলে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। কৃতজ্ঞ জাতি বেগম জিয়াকে আপসহীন দেশনেত্রীর সম্মানে ভূষিত করে সম্মানিত করেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের এবং দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করেই ক্ষান্ত হননি। সময়ে সময়ে বহু নির্যাতনও সহ্য করেছেন তিনি। ১/১১-এর সরকার তার দুই সন্তানের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তা ইতিহাসের যে কোনো কালো অধ্যায়কেও হার মানায়। তরতাজা দুজন যুবককে গভীর রাতে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেও তাদের পরবর্তী সময়ে নির্যাতন করে একজনকে প্রায় পঙ্গু করে দেওয়া হয়। আরেকজন ছোট ছেলে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরণ করলেও বেগম খালেদা জিয়াকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে ফেরানো যায়নি। মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ সরকারের আমলে বেগম খালেদা জিয়া তার জন্মদাত্রী মাকে হারান। তখন দুই ছেলে কারাগারে। পরিবারের সবাইকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলেও সবাইকে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি সংগ্রামে তার অবদান ও ত্যাগ জাতি যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত হিংসার বশবর্তী হয়ে দীর্ঘদিনের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে এক কাপড়ে বিতাড়িত করলেও বেগম খালেদা জিয়ার মনোবলকে দুর্বল করা যায়নি। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ইন্তেকাল করলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তবে কৃতজ্ঞ জাতি সাম্প্রতিককালের সর্ববৃহৎ জানাজায় অংশগ্রহণ করে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের এহেন প্রতিহিংসামূলক আচরণের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছিল।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে তার গুলশান কার্যালয়ের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে মাসাধিককাল বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার। অফিস থেকে বের হয়ে রাজপথের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইলে পুলিশ তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে পিপার স্প্রে দিয়ে তার অফিসকক্ষে আটকে দিয়েছিল। তারপরও গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রাম থেকে পিছপা না হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়া। তিনি চাইলে এই বয়সে আরাম আয়েশি জীবন বেছে নিতে পারতেন। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আপস করে চলতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি গণতন্ত্রের প্রশ্নে, মানুষের বাকস্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে বরাবরই ছিলেন আপসহীন। তাই তো এই বয়সেও তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় একটি ফরমায়েশি রায়ের মধ্য দিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য মানুষের মুক্তির আন্দোলন যেমন তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, তেমনি অনেক কিছু নিয়েও নিয়েছে। অকালে স্বামীকে হারিয়ে তিনি বিধবা হয়েছেন। নিজের ছোট সন্তানকে হারিয়েছেন। বড় ছেলে ১/১১ সরকার কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এখনো বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন এবং দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এদিকে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য এই বয়সেও জাতির প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তিনি তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ও মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তাই তো স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহিয়সী নারী। কৃতজ্ঞ জাতি তাই আজও পথ চেয়ে বসে আছে কবে বেগম জিয়া পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনের হাল ধরবেন। গণতন্ত্রের ঝান্ডা হাতে নিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবেন। সেই দিন আসবে, অবশ্যই আসবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: অধ্যাপক, উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হজ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি পেল ৩৩ বাণিজ্যিক ব্যাংক

আমরণ অনশনে অসুস্থ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষার্থী

পিআরে নির্বাচন হলে ৫৪ বছরের কলঙ্ক মুক্ত হবে : ডা. তাহের

৯ দফা দাবি রাবি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের

‘এক বাড়ির এতগুলো কবর খোঁড়ার কাম আগে কোনোদিন করিনি’

কে কাকে দিয়ে ক্ষমতায় আসবেন সেই প্রতিযোগিতা ভুলে যান : রেজাউল করিম

‘জয় বাংলা’ গানে বিভ্রান্তি, আ.লীগ ভেবে ছাত্র-জনতার অনুষ্ঠানে হামলা

রাজধানীতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলন, তারিখ ঘোষণা

চিকিৎসা পেশা নিয়ে মন্তব্যের জন্য ড. আসিফ নজরুলকে ক্ষমা চাইতে হবে : ড্যাব

রাকসু নির্বাচন / ভোটারের ৩৯ শতাংশই নারী, প্রার্থিতার আলোচনায় দুজন

১০

জন্মাষ্টমীতে কেশবপুরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা

১১

জুলাই সনদের খসড়ায় যা আছে

১২

বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি, ডুবেছে ফসলি জমি

১৩

আটলান্টিকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘এরিন’, কখন কোথায় আঘাত হানবে 

১৪

বাঘায় খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া মাহফিল

১৫

চাঁদার দাবিতে কারখানায় হামলা, আহত ৫

১৬

খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় বিএনপির দোয়া

১৭

কোচিংয়ে অস্ত্র-বিস্ফোরক, খায়রুজ্জামান লিটনের ভাইসহ আটক ৩

১৮

বিএনপির পক্ষে পাবনা-১ আসনে সাংবাদিক এম এ আজিজের প্রচারণা

১৯

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৮ অঙ্গীকারনামা

২০
X