বাংলার গ্রামাঞ্চল শুধু সুন্দর নদী, মাঠ ও গাছপালার জন্যই পরিচিত নয়; এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের এক বিশেষ কেন্দ্র। গ্রামীণ মানুষ শুধু নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সুন্দর করতে নয়, বরং শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাও ধরে রাখে। গ্রামবাংলার মাটির শিল্প সেই ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল দিক।
মাটির শিল্প বলতে আমরা শুধু মাটির পাত্র, পাত্রের ঢাকনা বা মাটির পুতুলকেই বুঝি না। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক প্রকাশ। গ্রামের মানুষ প্রায়ই মাটি হাতে নিয়ে বিভিন্ন আকৃতি ও নকশা তৈরি করেন। শীতকালে মাটির পাত্রে খাবার রাখা হয়, যা খাবারের স্বাদ ও তাজা রাখার জন্য উপকারী। গ্রামের আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব বা পূজার সময় মাটির তৈরি দেবী-দেবীর মূর্তি সাজানো হয়। এ মূর্তিগুলো শুধু শোভাময় নয়, বরং মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতিফলন।
মাটির শিল্পের জন্য গ্রামীণ মানুষের ধৈর্য, কল্পনা ও দক্ষতার প্রয়োজন। মাটি যেমন সহজ একটি পদার্থ, তেমনি এটি খুবই নমনীয়। সঠিক হাতের ছোঁয়ায় এটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরাও ছোটবেলা থেকে মাটির খেলনা তৈরি শেখে। তারা মাটির ঘর, পাখি, মানুষ বা পশুর মূর্তি বানিয়ে খেলে, যা তাদের সৃজনশীলতা বাড়ায়।
গ্রামের নারী-পুরুষরা বিভিন্ন রং ব্যবহার করে মাটির শিল্পকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন। কখনো লাল, কখনো হলুদ, কখনো সবুজ রং দিয়ে পাত্র বা মূর্তির নকশা করা হয়। এই রং শুধু শোভা বাড়ায় না, বরং শিল্পকে একটি গল্প বলতে সাহায্য করে। যেমন, মাটির দেবী-দেবীর চোখ, হাসি, পোশাকের নকশা সবই গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ও কল্পনার পরিচয় বহন করে। মাটির শিল্প শুধু গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ নয়, এটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বহুশতক ধরে এ শিল্প সমাজে রয়ে গেছে। প্রাচীন সময়ে বাংলার গ্রামের মানুষ মাটির পাত্র ব্যবহার করতেন পানি, দুধ, দই ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য। মাটির পাত্রের বিশেষত্ব হলো, এটি খাদ্যকে ঠান্ডা ও তাজা রাখে, যা এখনো গ্রামের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে অনেক শিল্পী শহরেও মাটির শিল্পকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তারা গ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আধুনিক রং, ডিজাইন ও আকৃতি ব্যবহার করছেন। এতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলন ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রদর্শনী ও আর্ট ফেয়ারে মাটির শিল্প দেখানো হয়, যা দেশের মানুষের কাছে গ্রামীণ শিল্পকে পরিচিতি দেয়।
মাটির শিল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শিশুদের শিক্ষায় এর ভূমিকা। শিশুদের হাতে মাটি নিলে তাদের সৃজনশীলতা, মননশীলতা ও ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। তারা মাটি দিয়ে ঘর, পশু বা পুতুল তৈরি করতে করতে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। এটি তাদের শেখার একটি কার্যকর পদ্ধতি। মাটির শিল্প আমাদের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কও তৈরি করে। মাটি প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব, যা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণে সাহায্য করে। আধুনিক যুগে প্লাস্টিক ও কৃত্রিম জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু মাটির শিল্প আমাদের প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। শিল্পী হওয়ার জন্য শুধু হাতের দক্ষতা নয়, মনে ভাবনা ও আবেগ থাকা প্রয়োজন। গ্রামবাংলার মানুষ সেই আবেগের ছোঁয়া দিয়ে মাটিকে জীবন্ত করে তোলে। মাটির শিল্প আমাদের শেখায়, কল্পনা, ধৈর্য এবং সৃজনশীলতা কীভাবে জীবনের সঙ্গে মেলানো যায়। এটি আমাদের শেখায় যে, সাধারণ একটি বস্তু যেমন মাটি, সঠিক চিন্তা ও পরিশ্রমে অসাধারণ কিছু হয়ে উঠতে পারে। আগামী প্রজন্ম গ্রামীণশিল্পকে চিনবে, অনুভব করবে এবং তাদের সৃজনশীল বিকাশ ঘটবে—এটাই চাওয়া।
আরশী আক্তার সানী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন