আলম রায়হান
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশি মাছ ধ্বংস বনাম রক্ষা প্রকল্প

দেশি মাছ ধ্বংস বনাম রক্ষা প্রকল্প

মাছ নিয়ে প্রধানত দুটি প্রবচন আছে। এক. ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। দুই. ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’। দ্বিতীয় প্রবচনের প্রথম অংশটি হচ্ছে, ‘লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে’। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবচনটি ইতিহাসের পাতায় লিখিত হওয়ার পরিণতির দিকে ধাবমান। আর ‘লিখিব পড়িব মরিব দুঃখে’—মাথার ‘তার’ পুরোটা ছেঁড়া না থাকলে এই বাক্য কেউ উচ্চারণ করবে না, বিবেচনায় নেওয়া তো অনেক দূরের বিষয়। এ প্রবচনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বহু আগে থেকেই শিশুদের শেখানো হয়ে আসছে, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ ইংরেজরা এ দেশে আসার পর এই প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে। সেই সময় কলকাতার বাবুরা সন্ধ্যার পর ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গায়ে উৎকট সুগন্ধি মেখে বেরিয়ে পড়তেন জুড়িগাড়ি করে। কোথায় যেতেন তা ইতিহাসের অন্ধকার পাতায় লেখা আছে। অনেকেই বলেন, লেখাপড়া নিয়ে ইংরেজদের সময় চালু হওয়া প্রবচন জাতির মননের বারোটা বাজিয়েছে। এদিকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে লেখাপড়ার সর্বনাশ হয়েছে। যে সর্বনাশকে পৈশাচিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আরও কয়েক ধাপ ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছেন। যেখান থেকে ফেরার কোনো চেষ্টা মোটেই দৃশ্যমান নয়। আর জুলাই আন্দোলনে অকল্পনীয় বিজয়ের পর ছাত্রদের মুকুটে ‘নিয়োগকর্তা’ পালক এবং পরবর্তী ঘটনাবলি ধারায় সিনেমার ডায়ালগের অনুকরণে বলা যায়, ‘শিক্ষা মায়ের ভোগে গেছে!’ একই পথে সম্ভবত এগোচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছও। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিগত সরকার আমলে নেওয়া একটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে শামুকও যুক্ত আছে। প্রকল্পটির পুরো নাম, ‘দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প’।

প্রকল্প বিষয়ে রচনা লিখতে বললে কেউ ইতিবাচক কিছু লিখতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর প্রকল্প বিষয়ে বাণীসম কথা বলেছেন বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পরিচ্ছন্ন এ উপদেষ্টার ২১ জুনের উচ্চারণ, ‘প্রকল্পে দুর্নীতি ও অযাচিত খরচ কমানো গেলে বাজেটে পরিচালন ব্যয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আগের সরকারের সময়ে টেন্ডার যোগসাজশেই প্রকল্পে ১০ শতাংশ দুর্নীতি হতো। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উপকারভোগীর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই ভূতুড়ে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় তালিকায় ঢুকেছে।’ কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য গৃহীত উল্লিখিত প্রকল্পের মেয়াদ ও আওতা বাড়লেও ব্যয় কমেছে অন্তত ১২ কোটি টাকা। হতে পারে অভূতপূর্ব এ ঘটনার পেছনে কারও নীরব মনিটরিং রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, উল্লিখিত প্রকল্প দিয়ে দেশি প্রজাতির মাছ ও শামুক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। কারণ, ধ্বংস প্রক্রিয়া সর্বগ্রাসী এবং নেপথ্যের গভীর ষড়যন্ত্র সুদূরপ্রসারী। দেশি মাছ ধ্বংসের যে মচ্ছপ চলছে, সেই তুলনায় উল্লিখিত প্রকল্প এবং তাবৎ উদ্যোগের অবদান সমুদ্রে এক ঘটি জলের বেশি কিছু নয়! প্রকৃতির দেশি মাছ ধ্বংস ধারা অব্যাহত রেখে চাষের মাছ দিয়ে শেষরক্ষা হওয়ার নয়। প্রবচনই তো আছে, ‘তোলাজলে পোলা বাঁচে না।’ তেমনই চাষের মাছে দেশ বাঁচবে না, প্রয়োজন প্রাকৃতিক পরিবেশের দেশি মাছের সুরক্ষা।

প্রসঙ্গত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে গত ২০ মে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, ‘সম্প্রতি বালাইনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং নিষিদ্ধ বালাইনাশকের সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন স্থানে মাছ ও গবাদি পশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শুধু মাছ ও পশু নয়, মানবস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্যও সমান ক্ষতিকর।’

নদীমাতৃক আমাদের দেশে অসংখ্য নদনদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে দেশব্যাপী। নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট নদীর সংখ্যা ১০০৮। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রবহমান নদী রয়েছে ৯৩১টি। কিন্তু আমাদের জাতিগত অর্বাচীন আচরণে কমছে নদী, খাল, বিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাশয়। যেসব নদী, খাল বা বিল রয়েছে, তাও আবার নাব্যহারা এবং বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত। একসময় আমাদের দেশে খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ ছিল। কিন্তু এখন উন্মুক্ত জলাশয়ে বেড়ে ওঠা দেশি জাতের মাছের সরবরাহ প্রায় তলানিতে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির দোরগোড়ায়ও রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি প্রজাতির মাছ। নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবন ভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—জমিতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক নামের বিষ প্রয়োগ, মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে মাছ ও পোনা ধরা, কলকারখানার বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’খ্যাত বরিশালের নদী থেকে মাছ এখন সাগরমুখী হয়েছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাছের উৎপাদন কি যথেষ্ট? মাথাপিছু ভোগ কি প্রয়োজন অনুযায়ী হচ্ছে? মাছের দেশীয় জাত বিলীন হওয়ার কারণ কী? কী কারণে ইলিশের এত দামের? মাছের ঘাটতি সত্ত্বেও মাছ রপ্তানি করা কি সংগত? আছে আরও অনেক প্রশ্ন। সমাধান কী? এদিকে সমুদ্রের মাছ নিয়ে ভাবা হয়। বন্ধ থাকে মাছ আহরণও। কিন্তু অভিযোগ আছে, আমরা যখন বন্ধ রাখি তখন আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র সমানে ধরে। মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয় নদীতেও। হাওরের জন্যও এমন বিধান আছে। কিন্তু এর বাইরে অসংখ্য খাল, যার দৈর্ঘ্য শত শত কিলোমিটার। সঙ্গে আছে অন্যান্য জলাশয়। কিন্তু এদিকে কারও নজর নেই।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশে আমাদের দেশে যে বিশাল মৎস্যভান্ডার ছিল, তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। নদী-খাল-বিলের মাছ যেমন অতি আহরণে ধ্বংস হচ্ছে তেমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ফসলে প্রয়োগকৃত কথিত বালাইনাশকের মারাত্মক বিষে। শুধু তাই নয়, এই বিষ প্রয়োগের ধারা পুরো পরিবেশ বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ নিয়ে পরিবেশ ব্যবসায়ীরা চুপ থাকবেন, এটি সহজেই বোধগম্য। যেমন বিড়ি-সিগারেট-তামাক নিয়ে তারা কোনো রা করেন না। কিন্তু পরিবেশবিদরা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন কেন? আর কথিত বালাইনাশক প্রসঙ্গে কেন কিছু বলছেন না আমাদের বাকপটু পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান! যদিও বললেইবা কী! তিনি পলিথিন নিয়ে এত বচন প্রদান করার পরও পলিথিনের আগ্রাসন ঠেকানো তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র কমেছে বলেও তো মনে হয় না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ভয় পান বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বৃক্ষচারা উৎপাদনে বন বিভাগ নিজেই পলিথিন ব্যবহার করে! অথচ বন উপদেষ্টা পলিথিনের বিরুদ্ধে গলাবাজি করেই যাচ্ছেন। সেই উক্তি স্মরণীয়—‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’ এরপরও আশার কথা হচ্ছে, হাওর অঞ্চলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রক্ষার জন্য কৃষি খাতে বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ/সীমিতকরণের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় উপদেষ্টাকে আহ্বায়ক করে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং একই ফরম্যাটে কমিটি গঠন করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন দুটি—এক. এ ধরনের কমিটির পাস্ট রেকর্ড কী? দুই. কেবল হাওরাঞ্চলে কেন, নয় কেন পুরো দেশ?

সর্বশেষ প্রধান উপদেষ্টার বাণীময় ১৮ আগস্টের বক্তব্য চেতনা ও কর্মে ধারণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতির প্রতি নির্দয় আচরণ অব্যাহত থাকলে একদিন মাছও আমাদের কপাল থেকে হারিয়ে যেতে পারে।’ এ সময় মাছকে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জন্য আল্লাহর দান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি যা বলেননি তা হচ্ছে, মাছসহ আল্লাহর অনেক নেয়ামতকে পায়ে ঠেলছি আমরা!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঘুমের সমস্যায় সবচেয়ে কার্যকর ব্যায়াম কোনটি? যা বলছেন বিজ্ঞানীরা

দরজা খুলতেই সন্তানের সামনে মাকে হত্যা

‘জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ না করলে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা’

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শরীয়তপুরে রোপণ করা হবে তিন লাখ গাছ

শান্তি চুক্তির আগে-পরে ইউক্রেনকে সহযোগিতায় প্রস্তুত যুক্তরাজ্য ও মিত্র দেশ 

ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের অধীনে কাজের সুযোগ, পদ ৬৩

জিএম কাদের ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

শেখ হাসিনা-কামালের মামলায় রাজসাক্ষী মামুনের জেরা চলছে

আইসিইউতে কিংবদন্তি লালন সংগীতশিল্পী ফরিদা, যা জানা গেল

তারেক রহমানের সহায়তায় নতুন জীবন পেল রাতুল

১০

তালাবদ্ধ ঘরে ব্যবসায়ীর লাশ, চিরকুটে লেখা ছিল হত্যার কারণ

১১

সংসার ভাঙল মোনালি ঠাকুরের

১২

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৪ পদে বড় নিয়োগ, আবেদন করুন দ্রুত

১৩

ঝাউবাগানে ঝুলছিল সাংবাদিকের মরদেহ

১৪

কালো জাদু হলে বুঝবেন কীভাবে? যে ৫টি আলামত বললেন বিশেষজ্ঞ আলেম

১৫

পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে পিটার হাসের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক

১৬

‘ছাত্র ও যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে বিএনপি’

১৭

বিপজ্জনক মধ্যপ্রাচ্য, যে কোনো সময় বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু 

১৮

কুখ্যাত সন্ত্রাসী কোপা মাসুদ গ্রেপ্তার

১৯

আপিল বিভাগের রায়ে তারেক রহমান নির্দোষ প্রমাণিত: কায়সার কামাল

২০
X