চলে গেলেন বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, প্রবীণ রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) দিনের শুরুতে এক দুঃসহ বেদনা হয়ে তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার এ চলে যাওয়া একেবারে আকস্মিক নয়। বার্ধক্য তাকে ঘিরে ধরেছিল অনেক দিন আগেই। বেশ কিছুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু। তবুও মৃত্যু মানেই গভীর দুঃখবোধ, মৃত্যু মানেই হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী শূন্যতা।
রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়িয়ে বদরুদ্দীন উমর একজন লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও নানা প্রয়োজনের সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মুখে এক, মনে আরেক, কাজে অন্য আরেক—এমন বাস্তবতার এক জনপদ বাংলাদেশে বেড়ে উঠেও কথা-কাজে অভিন্ন থাকতে পেরেছেন কমরেড বদরুদ্দীন উমর। মনে যা লালন করেছেন, মুখে তা বলেছেন। কাজে তা ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। সফল হন কি হননি, তা আরেক আলোচনা। কিন্তু নিজেকে অনাবিষ্কৃত রাখেননি। রহস্যঘেরা কাপালিক হয়ে থাকেননি বদরুদ্দীন উমর। মুখের কথাই মনের কথা, তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সম্মান-সম্মাননা গ্রহণে আপত্তিতে।
অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বদরুদ্দীন উমরকে মনোনীত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার ভাষ্য ছিল, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে তাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তিনি কোনোটিই নেননি। সেই চিন্তা-চেতনায়ও এবারও নেননি। যেখানে ভণ্ডে ভরা ভণ্ডামিতে ভণ্ডরাও গুরুর তকমা নেন, তিনি সেই পথ মাড়াননি। এর আগে, তিনি পেয়েছিলেন ফিলিপস পুরস্কার; তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যান করেন আদমজী পুরস্কারও। পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারও, তাও প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, একুশে পদক, সবশেষ স্বাধীনতা পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের ‘শীর্ষস্থানীয়’ ও ‘লোভনীয়’ পুরস্কার একের পর এক প্রত্যাখ্যান করা একজন কমরেড উমরের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। এসব দৃষ্টান্ত রেখে চলে গেলেন আমৃত্যু সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চকিত থাকা কমরেড।
উমরের গণঅভ্যুত্থান তত্ত্বই কামিয়াব হলো জুলাই অভ্যুত্থানে। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণঅভ্যুত্থানে গণবিরোধীদের পরাস্ত না করে কোনো নির্বাচন সুফল দেবে না। প্রমাণ ১৯৬৯ ও ১৯৯১। বিএনপি যে ২০১৪ ও ২০২৪-এর ভোট বর্জন করেছিল, সেটাও ওই লাইনেরই চিন্তা। কিন্তু উমর আরও এগিয়ে বলেছিলেন, শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানালেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এটা তার নির্বাচন না গণঅভ্যুত্থান বইয়ে বিস্তারিত আছে। আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদ হিসেবে প্রথম তিনিই চিহ্নিত করেন এবং সেই চোখেই তিনি গত ১৭ বছর লিখে গেছেন। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের খণ্ডন বদরুদ্দীন উমর করে গেছেন সারা জীবনের কাজে। ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে বসানো যায়নি, উমরের অকাট্য গবেষণা পুস্তক ও লেখালেখির জন্য। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অধীন, সেটাও তিনি মনে করতেন। আওয়ামী লীগের বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত, আওয়ামী লীগ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বাহন, এসব উমর ৭২ সাল থেকেই বলে আসছেন। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নিয়ে ছিল তার উচ্চাশার পারদ। তখন অনেকের কাছে এটি একটু বেশি মনে হয়েছে।
আজীবনের বিপ্লবী চিন্তায় সতেজ থেকেছেন ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রোববার সকালে তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। আজীবন অভ্যুত্থানপন্থি, বিপ্লবে বিশ্বাসী বদরুদ্দীন উমরকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের তত্ত্বকারও বলা হয়। গণঅভ্যুত্থানবাদী, আমৃত্যু কমিউনিস্ট মানুষটি চব্বিশের বিপ্লবের আগে ৭ জুন তার সম্পাদিত সংস্কৃতি পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে মেরে তাড়াতে হবে।’ তিনিই প্রথম জুলাই আন্দোলনকে উপমহাদেশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। দেশভাগের শিকার এই পা পশ্চিম বাংলা থেকে কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর-একাত্তর পেরিয়ে বাংলাদেশ অবধি হাঁটছে। এই পা জোড়া একজন কমিউনিস্টের। মস্তিষ্কটাও কমিউনিস্টেরই। দেশভাগের শিকারদের একজন। তবু শিথিল আবেগে জাতীয়তাবাদী না হয়ে হয়েছেন সাধারণ মানুষের মুক্তির পক্ষের সওয়ালকারী। ভাষা আন্দোলন থেকে আজ অবধি তাকে কেউ ক্ষমতার তাপে গলে যেতে দেখেনি, লাভের আশায় নুইয়ে পড়তে দেখেনি। শ্বাসকষ্ট ও রক্তচাপের সমস্যার কারণে গত ২২ জুলাই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল বদরুদ্দীন উমরকে। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসাতেও ফিরেছিলেন। কিন্তু এবার আর ফিরলেন না।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে রাজনৈতিক ঘরে জন্ম বদরুদ্দীন উমরের। তার বাবা আবুল হাশিম ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী তারকা রাজনীতিক। ১৯৫০ সালে উমররা ঢাকায় চলে আসেন। ততদিনে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে এসে উমর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক শেষ করে ১৯৫৫ সালে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর করেন। এরপর পড়তে যান যুক্তরাজ্যে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করেন ফিলোসফি, পলিটিকস ও ইকোনমিকসে (পিপিই)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করার আগেই দর্শন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগ দেন। তার হাত দিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। ষাটের দশকে প্রকাশিত তার তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তখন থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন বদরুদ্দীন উমর। বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীর দায়িত্বও পালন করেছেন। একসময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে সভাপতির দায়িত্ব নেন।
মাঝেমধ্যে নিজের চিন্তাচেতনা শেয়ার করতেন সিলেকটিভ কিছু গণমাধ্যমে। প্রতি বছর জন্মদিনে বিশেষ বিশেষ দিনে বলতেন কিছু কথা। এগুলো নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হলেও পরে নিষ্পত্তি আসেনি। আলোচনা-সমালোচনা কোনোটাই বেশিদূর গড়ায়নি। সেই ১৯৭২ সালে তিনি নিবন্ধ লেখেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’। তখনো বিএনপি জন্মাবে, এমন কল্পনাও কারও ছিল না। এই লেখায় তিনি বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ বলে চিনিয়ে দেন। বলেন, এটা আসলে নতুন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তাকে বাঙালিবাদী বলা অন্যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একাত্তরে যা ছিল, আর আজ তার গড়ন যা হয়েছে ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের হাতে, উমর দুটোরই ঘোরতর বিরোধী। তার ষাট বছরের সংগ্রামী জীবনে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ রয়েছে। শ্রেণি প্রশ্নে ছিলেন মারাত্মকরকম অনাপসী। মুক্তিযুদ্ধকে শ্রেণির নিরিখে বিচার করেন, আওয়ামী জাতীয়তাবাদী দাবি ও তার ইতিহাসকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে গেছেন। উপেক্ষার মাঝেও কেউ উমরকে অস্বীকার করতে পারেননি। তার সর্বশেষ দল জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল স্বাধীন দেশে কী করতে চেয়েছে? কাকে-কাদের মুক্তি দিতে চেয়েছে, তাদের কাছেও এ মুক্তিবার্তা পৌঁছানো যায়নি। ১৯৬৮-তে শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা উমরও নিজেকে উপেক্ষিত মনে করেছেন। কেন উমর নিজেকে উপেক্ষিত মনে করছেন, তা খতিয়ে দেখা হয়নি। উমর দেশের কাছে কী চেয়েছিলেন? ঠিক কী পেলে উমরের নিজেকে উপেক্ষিত মনে হতো না—এ বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। হয়নি কোনো নিষ্পত্তি।
বাংলাদেশে তার মতো হওয়ার, এমনকি তাকে অনুসরণ করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়ার মতো নয়। সাহসে, সততায়, ত্যাগে, পাণ্ডিত্যে এ অনন্যজনের বিদায়ের ক্ষত অনেক দিন সইতে হবে। এ বিদায় নৈতিকতার একজন মুরুব্বিহারা করল বাংলাদেশকে। হারাল ভিন্নমতের আরেক বড় সৌন্দর্য। তার সব চিন্তা, সব কথায় বিশ্বাসী না হলেও উমরের চিন্তা, যুক্তি ও সততার স্যালুট করতেই হয়েছে। শুরুতে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বরেণ্য আইনজীবী বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের পিতা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ প্রমুখ সতীর্থ ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। আজীবন তিনি আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মিথ্যা ও অসত্য ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিল শানিত। ভণ্ডামি ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন আজীবন।
তিনি শাসকের সব শোষণ-বঞ্চনা ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন। কারও কাছে বিক্রি হননি। এ মৃত্যুতে একটি যুগের সমাপ্তি হলো। তবে উমর যে চিন্তা লালন করেছেন, যে রাজনীতি করেছেন, বাংলাদেশে তা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল বা আছে—এ প্রশ্ন থেকেই গেল। ক্যারেক্টার হিসেবে অবশ্যই তিনি ইন্টারেস্টিং। এ সরকার আমলে ৭ মার্চ, ১৫ আগস্টসহ কয়েকটি দিবস বাতিলের প্রশংসা করে গেছেন বদরুদ্দীন উমর। বলেছিলেন, ১৫ আগস্ট কেন ছুটি থাকবে? ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, আব্রাহাম লিংকনকে খুন করেছে, ছুটি আছে? এই দিবসে কর্মসূচি করতে পারে, কিন্তু জাতীয় দিবস হিসেবে ছুটি কেন? বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান করার পক্ষে বদরুদ্দীন উমর। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সংবিধান চেয়ে গেছেন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন