হেনা শিকদার
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

সৃজনশীলতার নামে মুখস্থবিদ্যা

সৃজনশীলতার নামে মুখস্থবিদ্যা

বাংলাদেশে যখন সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল, তখন তা এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। শিক্ষাবিদ, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা ভেবেছিলেন, এবার হয়তো মুখস্থবিদ্যার জগদ্দল পাথর বুকের ওপর থেকে সরবে। গাইড বই আর সাজেশননির্ভর পড়াশোনার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধা ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে শিখবে। জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ এবং উচ্চতর দক্ষতার চারটি ধাপে সাজানো এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (critical thinking) এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি করা।

কিন্তু এক দশকের বেশি সময় পর আজ যখন আমরা এ পদ্ধতির ফলপ্রসূ দিকটি বিশ্লেষণ করতে বসি, তখন এক অমোঘ বাস্তব আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যে মুখস্থবিদ্যাকে বিদায় জানানোর জন্য এত বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেই মুখস্থবিদ্যাই এক নতুন এবং আরও ভয়ংকর রূপে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। সৃজনশীলতার নামে যা চলছে, তা এক ধরনের কাঠামোবদ্ধ মুখস্থবিদ্যা, যা শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের মেধা বিকাশের পথে এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অন্ধকার দিকের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গাইড বই এবং কোচিং সেন্টারগুলোর দৌরাত্ম্য। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নগুলো যেহেতু পাঠ্যবইয়ের নির্দিষ্ট অধ্যায় থেকে তৈরি হয়, তাই এর উত্তর দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ওই অধ্যায় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উল্টো। শিক্ষার্থীরা মূল বই পড়ার পরিবর্তে বাজারের হাজারো গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এই গাইড বইগুলো প্রতিটি অধ্যায়ের ওপর সম্ভাব্য শত শত সৃজনশীল প্রশ্ন ও তার উত্তর তৈরি করে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সেই প্রশ্ন আর উত্তরগুলোই নির্বিচারে মুখস্থ করছে। ফলে, পরীক্ষার হলে যখন প্রায় একই ধরনের বা কমন প্রশ্ন আসে, তখন তারা মুখস্থ করা উত্তরটিই উগরে দিয়ে আসে। এখানে না থাকে তাদের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন, না থাকে অনুধাবন বা প্রয়োগের দক্ষতা। জ্ঞান স্তরের উত্তরটি হয়তো তারা সঠিকভাবে দিতে পারে, কিন্তু অনুধাবন, প্রয়োগ এবং উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে তাদের উত্তরগুলো হয় যান্ত্রিক ও গৎবাঁধা।

এই নতুন পদ্ধতির মুখস্থবিদ্যা আগের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। কারণ, আগে শিক্ষার্থীরা কেবল নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করত। আর এখন তারা একটি নির্দিষ্ট ‘প্যাটার্ন’ বা ‘ফরম্যাট’ মুখস্থ করছে। ‘ক’ নম্বর প্রশ্নের উত্তর কেমন হবে, ‘খ’ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কিংবা ‘গ’ ও ‘ঘ’ এর উত্তর কীভাবে সাজাতে হবে—তার সবই তাদের কোচিং সেন্টার ও গাইড বইগুলো শিখিয়ে দিচ্ছে। ফলে, একজন শিক্ষার্থীর খাতা দেখলে সহজেই বোঝা যায়, সে কি বিষয়টি বুঝে নিজের ভাষায় লিখেছে, নাকি কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরণ করে মুখস্থ লিখেছে। পরীক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে এই গৎবাঁধা উত্তরের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের সৃজনশীল উত্তরকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে যারা প্রকৃতই সৃজনশীল, তারা অনেক সময় ভালো নম্বর পাচ্ছে না, যা তাদের হতাশ করে তুলছে।

এ পরিস্থিতির জন্য কেবল শিক্ষার্থী বা গাইড বই ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে চলবে না। এর পেছনে বেশ কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটিও বিদ্যমান। প্রথমত, আমাদের শিক্ষকদের একটি বড় অংশকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা যায়নি। কীভাবে একটি মানসম্মত সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে হয় এবং কীভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর মূল্যায়ন করতে হয়, সে সম্পর্কে অনেক শিক্ষকেরই পরিষ্কার ধারণার অভাব রয়েছে। ফলে তারাও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার দিকেই ঠেলে দেন। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন গাইড বই বা টেস্ট পেপার থেকে প্রশ্ন হুবহু তুলে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের গাইড বইনির্ভর হতে আরও উৎসাহিত করে।

দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত পরীক্ষা এবং জিপিএ-কেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা এ ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অভিভাবকরা চান তাদের সন্তান পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল করুক। এই ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য তারা কোচিং সেন্টার এবং গৃহশিক্ষকের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আর এই কোচিং সেন্টারগুলোর মূল ব্যবসাই হলো ‘কমন’ প্রশ্নের সাজেশন দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী উত্তর মুখস্থ করানো। ফলে, শেখার আনন্দের পরিবর্তে পরীক্ষা পাসের চাপই শিক্ষার্থীদের মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৃজনশীলতার আলোয় আলোকিত হওয়ার বদলে তারা পরীক্ষার নম্বরের এক অন্ধকার টানেলে হারিয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের চিন্তার ক্ষমতা, লেখার দক্ষতা এবং মৌলিকত্ব দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তারা পাঠ্যবইয়ের গভীরে প্রবেশ করতে শিখছে না, শিখছে কেবল তথ্যকে একটি নির্দিষ্ট ছকে উপস্থাপন করতে। ফলে উচ্চশিক্ষার স্তরে গিয়ে তারা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যখন তাদের গবেষণাধর্মী বা বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখতে বলা হয়, তখন তারা নিজেদের অক্ষমতা টের পায়।

এই অন্ধকার থেকে বেরোনোর পথ কী? প্রথমত, শিক্ষকদের ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন তারা নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন এবং শিক্ষার্থীদের সেভাবে ভাবতে শেখাতে পারেন। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। গাইড বই থেকে প্রশ্ন কপি করার প্রবণতা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে এবং প্রশ্নপত্রে এমন অভিনবত্ব আনতে হবে যাতে মুখস্থনির্ভর শিক্ষার্থীরা উত্তর দিতে না পারে। তৃতীয়ত, মূল পাঠ্যবইকে আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের সাহায্য ছাড়াই তা পড়তে আগ্রহী হয়। সবশেষে, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থীর মেধা বিচার না করে, বছরব্যাপী তার ক্লাস পারফরম্যান্স, প্রজেক্ট ওয়ার্ক এবং অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়নের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, কিন্তু এর প্রয়োগের ব্যর্থতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক মহা সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৃজনশীলতার মুখোশের আড়ালে যে মুখস্থবিদ্যার চাষাবাদ চলছে, তা বন্ধ করতে না পারলে আমরা একটি চিন্তাশীল ও মেধাবী জাতি গঠন করতে ব্যর্থ হব। সময় এসেছে এই পদ্ধতির গলদগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত সংস্কার করার, নতুবা ‘সৃজনশীল’ শব্দটি আমাদের শিক্ষা ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

হেনা শিকদার, শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, দর্শন বিভাগ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাটোরে বাসচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

প্রথম দেখাতেই মানুষ চিনে নিন ৫ মনোবিজ্ঞানভিত্তিক ট্রিকসে

পাচার অর্থ ফেরাতে / ১২টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চুক্তি করতে নির্দেশ

খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের গোপন আস্তানায় অভিযান, অস্ত্র উদ্ধার

সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জনের অপসারণ দাবিতে অফিস ঘেরাও

এভারেস্ট উপত্যকায় শতাধিক পর্যটক আটকা, উদ্ধার অভিযান চলছে

জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবসের আয়োজনে বক্তারা / জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সর্বজনীন করতে আইন সংস্কার অপরিহার্য

তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠক

ভর্তার স্বাদ বাড়াতে জানুন ছোট্ট কিন্তু দারুণ কিছু টিপস

ট্রেনে কুবি শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করায় ৫ যুবক আটক

১০

যাই দেখছি সব নতুন লাগছে, বিসিবি নির্বাচনে ভোট দিয়ে আমিনুল

১১

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্যকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখি : নিলোফার মনি

১২

নারী সহকর্মীদের নিয়ে বিস্ফোরক দাবি রুনা খানের

১৩

‘উপসর্গ থাকলেও নারীর মৃত্যু অ্যানথ্রাক্সে নয়’

১৪

ওমরাহ নিয়ে সুখবর দিল সৌদি আরব

১৫

জামায়াত আমিরের সঙ্গে কসোভোর রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৬

আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৯ ইউনিট

১৭

দুর্ঘটনায় মা হারানো শিশুটির কান্না থামাবে কে ‎

১৮

দাউদকান্দি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুমন গ্রেপ্তার

১৯

বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, তার সঙ্গে কাজ করবে ভারত: বিক্রম মিশ্রি

২০
X