

জুলাই সনদ নিয়ে নানামুখী আলোচনা অব্যাহত আছে। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদকে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চেষ্টার ফসল হিসেবে দেখতে হবে। এ প্রচেষ্টা শুধু জাতীয় সনদের মধ্য দিয়ে হচ্ছে, তা নয়। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো এবং তার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ এবং প্রত্যাশা পোষণ করে আসছে। জুলাই সনদ সেই সম্মিলিত প্রত্যাশাকেই ধারণ করার চেষ্টা। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রক্ষমতাকে যেভাবে ব্যক্তিকরণ করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে একটি পুনর্গঠন অপরিহার্য ছিল। সে বিবেচনা থেকেই দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সনদটি তৈরি হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, যে কোনো রাজনৈতিক দলিলই একটি সূচনা। এটি রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার চলমান অংশ, যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তা আজও অব্যাহত আছে। অঙ্গীকারের দিক থেকে এ সনদকে বাস্তবসম্মত বলেই মনে করছেন ড. আলী রীয়াজ। তবে জুলাই বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা এটাকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না। ফলে তারা এ সনদে অদ্যাবধি স্বাক্ষর করেননি। কেন করেননি সে ব্যাখ্যাও তারা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর দেশে দুটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়। এরশাদের পতনের আগে তিন জোট রূপরেখা ঘোষণা করেছিল। এরশাদ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী পদত্যাগ করলেও পরবর্তী সরকারগুলো এ রূপরেখা বাস্তবায়ন দূরে থাক, এটা কখনো সামনেই আনেনি। উল্টো আমরা দেখলাম দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পর্যায়ক্রমে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে রাজনীতি করতে। যদিও তিন জোটের রূপরেখায় উল্লেখ করা হয়েছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরাচারী এরশাদকে পুনর্বাসন করা হবে না। তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা হবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চব্বিশের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে সংস্কারের কথা উঠছে। যেমনটি উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের আগে। স্বাধীনতার পরের ঘটনাও ওই একই। অভিন্ন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলো, কিন্তু বিপ্লব ঘটল না। মানুষের মুক্তির জন্য যা প্রয়োজন ছিল, তা হলো সামাজিক বিপ্লব। সেটি ঘটানো সাতচল্লিশের পরে সম্ভব হয়নি, সম্ভব হলো না একাত্তরের পরও। রাষ্ট্রক্ষমতা যে শ্রেণিটির হাতে চলে গেল তারা সামাজিক বিপ্লব চায়নি, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন হর্তাকর্তা হতে চেয়েছে। রাষ্ট্রের নাম বদলিয়েছে, তার আয়তনে পরিবর্তন হয়েছে, শাসনকর্তাদের বাইরের চেহারাটাও হয়েছে ভিন্ন ধরনের, কিন্তু তার ভেতরের চরিত্রটা রয়ে গেছে আগের মতোই, এটিই হলো নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। তাই রাষ্ট্র বদলেও ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্র হয়ে রইল পুরোনো সমাজকাঠামোর পাহারাদার হয়েই, স্বাধীনতার আগে যেমনটি ছিল। স্বাধীনতার পর এ রাষ্ট্র আরও নির্মম হাতে শাসকদের শ্রেণিগত স্বার্থকে রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো।
আমরা মনে করি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ আমাদের হাতে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পেরেছে যে, এ মুহূর্তে জুলাই সনদের সবকিছু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, কিন্তু তারা বিষয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় বা অকিঞ্চিৎকর বলে উড়িয়ে দেয়নি। আশার প্রদীপের শিখা ম্রিয়মাণ হলেও একেবারে নিভে যায়নি। আমাদের প্রত্যাশা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হবে। অন্যথায় তাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
মন্তব্য করুন