

মুহম্মদ আব্দুল খালেক সম্পাদিত ‘শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক’ বইটি হাতে নিয়ে অনেকদিন পর আমার নানা বাড়ির বাইরের ঘরটির কথা মনে পড়েছিল। সেই ঘরে নেই এমন জিনিস নেই, খাট আছে, বিছানা আছে, চেয়ার পাবেন বসবার, পাট আছে স্তূপ করা এক কোণে, এবং হঠাৎ যদি দুর্যোগ দেখা দিত আবহাওয়ায়, বৃষ্টি অথবা শীত, তবে সদ্যোজাত বাছুরেরও আশ্রয়ের স্থল ছিল সেটি, ওই বাইরের ঘর। পাঁচশ পৃষ্ঠার এই বড় বইতেও অনেক কিছু, বলতে পারি সবকিছু আছে—প্রবন্ধ, বক্তৃতার উদ্ধৃতি, চিঠি, অনুবাদ কবিতা, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, ঘটনাপঞ্জি; বাদ নেই কিছুই।
সব কিছু হক সাহেবের নিজের জীবনেও ছিল। শতাব্দীর ছবি ছিলেন তিনি, প্রায় এক শতাব্দীর সময় সীমায় এ অঞ্চলের জীবনধারায় যেসব ধারা ও প্রবণতা কার্যকর ছিল, অবস্থান ছিল যে সব চড়াই-উতরাইয়ের, উদ্যোগ ও আকাঙ্ক্ষার এবং স্ববিরোধিতার, তাদের অনেকগুলোই প্রতিফলিত হয়েছিল তার জীবনের বিভিন্ন প্রসারণ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে। ‘শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক’ সংকলনের একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ যথার্থই বলেছেন, ‘ব্যক্তিত্বের বিশালতায়, চরিত্রের বিচিত্রতায়, কলিজার প্রসারতায়, জীবনের ব্যাপকতায় তার গ্রেটনেস প্রতিবিম্বিত।’ গ্রেট বলেই তিনি কখনো-কখনো ছিলেন ইনকম্প্রিহেনসিবল। কিন্তু শুধু গ্রেট তো নয়, সেইসঙ্গে প্রতিনিধিও ছিলেন তার কালের। বলা যায়, সেখানেও গ্রেট ছিলেন তিনি, সেই প্রতিনিধিত্বে। নিম্ন মধ্যবিত্তের শুচিবাই ছিল না তার, বর্জন ছিল না মানসিকতায়, যেমন ছিল না কাজী নজরুল ইসলাম ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে। সবাইকে নেবেন, সব কিছুকে নেবেন, নিতে গিয়ে স্ববিরোধী হতে হলে হবেন—তবু নেবেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি জানতেন এবং বাংলাও অনেক রকমের, বরিশালের, কলকাতার, ঢাকার, যেমন চাষির, তেমনি রবীন্দ্রনাথের।
এই যে বৃহৎ পুরুষ হক সাহেব তাকে আমরা শেরে বাংলা বলি কেন, বলব কেন, কেন বলতে থাকব? পুরোনো প্রশ্ন, নতুন করে মনে এলো বইটি হাতে নিয়ে। মানুষকে মানুষ হিসাবে, বৃহৎ ও মহৎ মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে, তাকে একটা মূর্তিতে পরিণত করার প্রাচীন ও পৌত্তলিক প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতিতে অব্যাহতরূপে আছে। ফজলুল হকের মধ্যে বাঘের গুণ ছিল, সাহস ছিল প্রচণ্ড, তেজস্বিতা প্রকাণ্ড। ভয় ও ভীরুর দেশে সাধারণ গুণ নয় সাহস ও তেজস্বিতা, অহরহ দেখা-সাক্ষাৎ হয় না পথে-ঘাটে, সাহসী ও তেজি বাঘ সুন্দরবনেই বা কয়টি আছে, লোকালয়ে নেই, মানুষের উৎপাতে মরেছে, আমরা মেরে সাবাড় করেছি। সাহস ও তেজস্বিতার মূল্য আমরা দেব, হক সাহেবের সাহসী ও তেজি রাজনীতির কাছে আমাদের সমষ্টিগত কৃতজ্ঞতাও থাকবে, কিন্তু বাঘ কেন বলতে যাব তাকে, তার প্রধান পরিচয় এই নয় যে, তিনি মানুষের ছদ্মবেশে বাঘ ছিলেন একটি, প্রধান পরিচয় তিনি মানুষ ছিলেন একজন, মানুষের মতো মানুষ। আমাদের দেশে লোক আছে অনেক, বহু লোকে বলে মাত্রাতিরিক্ত, কিন্তু মানুষ নেই তেমন, মানুষের মতো মানুষ অত্যন্ত অল্প। শুধু বাঘ বললে কি তার মানবিক গুণগুলোকে স্বীকার করা হয়, বাঘের জন্য সেসব গুণ গুণ নয় আদপেই, দুর্বলতা বড় বড়, যাদের থাকতে নেই বাঘে, থাকলে বাঘ বাঘ থাকে না, মানুষ হয়ে পড়ে? সেই যে পীড়িতের প্রতি ভালোবাসা, নিষ্পিষ্টের প্রতি মমতা ছিল হক সাহেবের মধ্যে সেগুলো কি আমরা স্বীকার করি, সম্মান করি যখন বলি তিনি বাঘ ছিলেন একজন? তিনি প্রথম শ্রেণির ব্যাঘ্র ছিলেন না, প্রথম শ্রেণির মানুষ ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণির বাঘ কি অধিক সম্মানার্হ প্রথম শ্রেণির মানুষের তুলনায়? হলে তা দুঃখজনক হবে বৈকি।
সাহস ও তেজস্বিতা বড় গুণ নিশ্চয়ই, কিন্তু তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বিকল্প নয় মনুষ্যত্বের। হক সাহেবকে আমরা তাই ফজলুল হক হিসেবেই দেখব, বাঘ হিসেবে নয়। আর ওই যে নাম ‘শের-ই বাংলা’ ওই নামকে যে বেষ্টন করে আছে উৎকট ও কিম্ভূত, তাও কি অস্বীকার করতে পারব আমরা? শ্রদ্ধাভাজনের গলায় কি উৎকটের কিম্ভূত ঝুলাব আমরা, ঝুলিয়েই রাখব?
দুই
হক সাহেব কোনো আত্মজীবনী লেখেননি। লিখলে তা মূল্যবান হতো। তার অভিজ্ঞতা ছিল অপরিমেয়, ঘটনাবহুল ছিল জীবনের প্রতিটি স্তর, একটি পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে গেছেন তিনি। আত্মজীবনী রচনার জন্য অপরিহার্য আর একটি গুণ ছিল তার, যাকে বলা যায় অন্তর্দৃষ্টি। ঘটনার তাৎপর্য ও তার অন্তর্নিহিত কারণের মর্ম বিদ্ধ করবার শক্তি ছিল তার মধ্যে। কিন্তু লিখলেন না কেন আত্মজীবনী? সে কি শুধু সুযোগের অভাবে, সময়ের অভাবে? তা নয়। তার সাহস ছিল না। সাহসী মানুষটিও সন্ত্রস্ত ছিলেন এক জায়গায়। আবারও বলতে হয়, মানুষ ছিলেন প্রকৃত, আদর্শ বাঘ ছিলেন না। তাকে জানতেন যারা, তাদের একজন এ বইতে উদ্ধৃতি দিয়েছেন হক সাহেবের একটি বক্তব্যে, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেক মিথ্যা ভ্রান্তি আছে। আত্মজীবনীতে সেই মিথ্যা ও ভ্রান্তি টেনে আনতে চাই না। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় যে জীবনী বা ইতিহাস- তা ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়।... আত্মজীবনী লেখার কাজে আমি তাই কিছু সময় নিচ্ছি। অকপটে সব সত্য কথা বলার সাহস সঞ্চার করছি।’ সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয় করছেন এই সত্য আবার প্রমাণ করল মূল সত্যকে, মানুষের মতো মানুষ ছিলেন তিনি একজন, সত্যের মূল্য জানতেন, সত্য যে ভয়ংকর-মানুষের চেয়ে, শাসকের উগ্রতম রক্তচক্ষুর তুলনাতেও সে যে অধিক ভয়াবহ, তা তিনি জানতেন। চাটুকারদের তুলনায় স্বভাবতই অনেক বড় ছিলেন তিনি। ভীত ছিলেন বলেই।
তার সম্পর্কে যেসব বই লেখা হয়েছে তার প্রায় সবকটিতেই উল্লেখ আছে তার ক্ষুরধার বুদ্ধির, দক্ষ চাতুর্যের, মৌলিক উদ্ভবনাশক্তির। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে তার উপস্থিত বুদ্ধির তৎপরতা ছিল একেবারে অনলস। কিন্তু ব্যক্তিগত কৌশল ও চাতুর্য, বুদ্ধি ও দক্ষতা ব্যক্তির পক্ষে সম্পদ হলেও সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক যে সদাসর্বদাই হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? প্রতারক যদি অত্যন্ত দক্ষ ও ভীষণ চতুর হয়, তবে তাতে আমি-আপনি উল্লসিত হব কোন সুখে, অথবা আশায়? কোন কাজে লাগছে ওই দক্ষতা ও চাতুর্য সেই প্রশ্নটি গৌণ নয়, মুখ্য। হক সাহেবের উপস্থিত বুদ্ধির জয়ধ্বনি করার সময় এ মুখ্য বিবেচনাটি অনেক সময় হারিয়ে যায় দেখেছি। একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে নমিনেশন না দিয়ে অশিক্ষিত এক সর্দারকে কেন নমিনেশন দিলেন এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হক সাহেব নাকি একবার বলেছিলেন, শিক্ষিত লোকরা ব্যাঙের মতো; কেবলই লাফায়, অ্যাসেম্বলিতে আমরা ব্যাঙ চাই না। পরে আরেক সভায় একজন উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে তিনিই বলেছিলেন, বাজারে হাঁড়ি কিনতে গেলে আপনারা কী করেন? বাজিয়ে দেখেন। আমার প্রার্থীকে বাজিয়ে দেখে নিন। দাও তো তুমি বক্তৃতা। প্রার্থী প্রথমে গরম ইংরেজিতে, পরে সাধু বাংলায়, শেষে চোস্ত উর্দুতে অনর্গল বক্তৃতা করে গেলেন। হক সাহেব বললেন, দেখেন, দেখেন এই হাঁড়ি কেমন বাজে। কেমন শব্দ করে। উভয়ক্ষেত্রেই বুদ্ধির প্রশংসা করতে পারি অনায়াসে, কিন্তু রাজনীতিতে শিক্ষিত লোক চাই নাকি অশিক্ষিত লোক—এ প্রশ্ন উঠলে তার কী মীমাংসাটা করব আমরা? কী মীমাংসা হক সাহেব নিজে দিলেন? মিথ্যা ও ভ্রান্তি ছিল বৈকি তার রাজনৈতিক জীবনে, চাটুকাররা না জানুক, তিনি জানতেন, তিনি সেই সত্যকে ভয়ও করতেন, তিনি অনেক বড় ছিলেন ছোট ছোট চাটুকারদের তুলনায়।
কবিদের অবশ্য লাইসেন্স দেওয়া যায়। পোয়েটিক লাইসেন্স—ব্যাপারটা অবাস্তবিক নয়। যেমন কবি জসীমউদদীন যে প্রশংসা করেছেন হক সাহেবের দক্ষতা ও চাতুর্যের, সেই প্রশংসায় কবির দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে। দুটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি সংকলনান্তর্গত তার প্রবন্ধে। ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের ঘটনা। দাবি উঠেছে রাজবন্দিদের মুক্তির। হক সাহেব জানেন মুক্তি দেওয়ায় বিঘ্ন আছে। ঢাকার এক জনসভায় দাঁড়িয়ে হক সাহেব বললেন, বিপ্লবীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আপনাদের কারও চাইতে কম নয়। জসীমউদদীন লিখছেন, ‘এই বলিয়া হক সাহেব তাঁহার আচকানের পকেট হইতে দুইখানা পত্র অতি গদ গদ ভাষায় পড়িয়া গেলেন। পড়িতে পড়িতে এক স্থানে তাঁহার দুই চোখে পানি গড়াইয়া পড়িলো। উহার পর সভার মত পরিবর্তিত হইয়া গেল। বিপ্লবীদের জেল হইতে আর মুক্তি দেওয়া হইল না। আজও আমার বিশ্বাস এই পত্র দুইটি কোনো বিপ্লবী দলের নিকট হইতে আসে নাই। হয় ইহা হক সাহেব কাহাকে দিয়া রচনা করাইয়া লইয়াছিলেন অথবা দু'খণ্ড লিখা কাগজ লইয়া তিনি নিজের মনোক্তিতেই সবকিছু বলিয়া গিয়াছিলেন।’
দ্বিতীয় ঘটনাও ঢাকারই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি, বক্তৃতায় ‘হক সাহেব বলিয়া বসিলেন, শুনিয়াছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবীদের আড্ডাখানা। তা যদি সত্য হয় তবে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুড়িগঙ্গার অতল তলে ডুবিয়া যায়।’ কেন বললেন এ কথা? ‘হক সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল ওই বক্তৃতা দিয়া লাটসাহেবের মনোরঞ্জন করিবেন।’ তা লাটসাহেবের মনোরঞ্জন কতটা হলো সেটা বোঝা গেল না বটে; কিন্তু দেশবাসীর মধ্যে চতুর্দিকে সমালোচনার ‘ঢি ঢি পড়িয়া গেল’। ‘কয়েকদিন পরে তিনি পত্রিকায় একটি বিবৃতি দিয়া বলিলেন,…ঐ বক্তৃতাটি তৈরী করিতে আমি একজন মহান হিন্দু নেতার অমুক সনের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে প্রদত্ত বক্তৃতার অনুকরণ করিয়াছিলাম। ইহা বলিয়া তিনি তাঁহার নিজের বক্তব্যের পাশাপাশি স্যার আশুতোষের কোনো এক সমাবর্তন বক্তৃতার অংশবিশেষ উদ্ধৃতি করিয়া ছিলেন।’ সমালোচকরা, যাদের বেশিরভাগই হিন্দু ছিলেন, আচ্ছা জব্দ হলেন।
জসীমউদ্দীন প্রশংসা করেছেন হক সাহেবের এই বুদ্ধির। কিন্তু যদি কেউ বলেন জনসাধারণের পক্ষাবলম্বনকারী রাজনীতি-বিশ্লেষক তো বটেই এমনকি নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকও যদি বলেন যে, ওই দক্ষতায় প্রশংসার কিছু নেই, কেননা এর মধ্যে একটা প্রতারণা আছে, তবে তার জবাব দেব কি? প্রতারণা যিনি করেছেন তাকে দোষ দেব সোৎসাহে, কিন্তু যারা প্রস্তুত ও ব্যগ্র হয়ে বসে আছেন প্রতারিত হওয়ার জন্য তারাও কি যোগ্য পাত্র প্রশংসার? আর যারা প্রতারণাকে প্রশংসা করে তারাই বা কতটা আদরণীয়?
হক সাহেব যে তার নিজের বক্তৃতার সঙ্গে ওকালতি ব্যবসায়ে তার একদা-সিনিয়ার ‘স্যার’ আশুতোষের বক্তৃতার হুবহু সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন সেখানে, সেই আবিষ্কারে একটা আকস্মিকতা আছে, কিন্তু দুই বক্তৃতার সাদৃশ্যটা কি আকস্মিক? ‘স্যার’ আশুতোষের বক্তৃতা হয়তো স্মরণেই ছিল না তার, স্মরণ না করেই লিখেছিলেন নিজের বক্তৃতা, কিন্তু সাদৃশ্য মোটেই অকস্মিক নয়, দৈবক্রমে ঘটেনি, আপতিক ঘটনা নয় তাদের মিল। বরঞ্চ বলতে হয়, বলতেই হবে, যে, সাদৃশ্যটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, সাদৃশ্য দর্শনে আমরা অবাক হই না, অবাক হতাম সাদৃশ্যের অভাব ঘটলে। কারণ কি? কারণ, শ্রেণি। একই শ্রেণি থেকে এসেছেন তারা। সেখানে হিন্দু-মুসলমান নেই, কলকাতা-বরিশাল নেই, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও আবুল কাশেম ফজলুল হক সেখানে অভিন্ন মানুষ; তারা লাটসাহেবদের, মনোরঞ্জন-বাসনায় কেউ কারও চেয়ে কম যান না। সত্য এটাও—এ সত্যকেও হক সাহেব জানতেন, মনে হয়, একে ভয় পেতেন আত্মজীবনী রচনার সাহস সঞ্চয় করতে তাই তিনি সময় নিচ্ছিলেন।
তিন
যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ফজলুল হকের ছিল তাই দিয়ে তিনি দেখে নিয়েছিলেন এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের, কৃষক-প্রজার মূল আকাঙ্ক্ষাটির স্বরূপ কী। কৃষক-প্রজা চায় জমিদারের শোষণ থেকে মুক্তি, চায় অশিক্ষার নিপীড়ন থেকে মুক্তি। হক সাহেবের কৃষক-প্রজা পার্টি ১৯৩৭ সালে যে নির্বাচনী মেনিফেস্টো দিয়েছিল, তার প্রথম কথাটাই ছিল বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে চিরতরে শেষ করতে চেয়েছিলেন তিনি ও তার দল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল প্রাণপণে, কিন্তু সে লাড়ই প্রবল হয়নি, বৈপ্লবিক হয়ে ওঠেনি দেশের অধিকাংশ মানুষকে সঙ্গে নিতে পারেনি বলে। শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ বন্দি ছিল সামন্ত ও মহাজনি শোষণের নিগড়ে। সেই বন্দি মানুষদের মুক্ত করার আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন যদি একত্রে, একসঙ্গে চলত, তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসত দেশে, তা হয়নি যে সে আমাদের মস্ত বড় দুর্ভাগ্য।
হক সাহেব কৃষক-প্রজাদের কথা বললেন। তার দল কর্মসূচির প্রথমে রাখল জমিদারি প্রথার অবসানকে। জমিদাররা প্রায় সবাই ছিল হিন্দু, প্রজাদের অধিকাংশই মুসলমান। এ খাত বেয়ে সাম্প্রদায়িকতা এসে গিয়েছিল রাজনীতিতে। মুসলমান সমাজের সামনে প্রশ্ন এলো: তাদের কোন পরিচয়টি প্রথম? তারা কি আগে মুসলমান, পরে নির্যাতিত মানুষ, নাকি আগে নির্যাতিত মানুষ, পরে মুসলমান? হক সাহেবের দল বলল, নির্যাতিত মানুষ এটাই প্রথম কথা, অন্যরা, মুসলিম লীগ ও ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি বলল, উল্টো কথা, বলল, আমরা আগে মুসলমান, পরে অন্য কথা।
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই দুই মতের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মুসলমানদের তিনটি দলের মধ্যে নির্বাচনী ঐক্যের চেষ্টা হয়েছিল। ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি ছিল জমিদারদের দল, মুসলিম লীগে নেতৃত্ব ছিল অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে। এই দুই দল এক হয়ে গেল সহজে, জমিদারে-ব্যবসায়ীতে, সামন্তে-বুর্জোয়াতে গলাগলি ভাব হতে বিলম্ব ঘটল না। মুশকিল বাধাল হক সাহেবের কৃষক-প্রজা পার্টি। তাদের কর্মসূচির প্রথমেই আছে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ। অন্য দুই দল ইহই করে উঠল, সে কী কথা, ওতো অনৈস্লামিক।
ঐক্য হয়নি। হক সাহেব নির্বাচনী প্রচারণায় স্পষ্ট করেই বললেন, ওই যে পরগাছা, ওই যে বাদুড়, জমিদার, ওদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। ‘আমি যদি ক্ষমতা হাতে পাই তবে আল্লাহর রহমতে জমিদারি জন্মের মতো উৎখাত করব।... আমি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে নবযুগের সৃষ্টি করব।’ জমিদার নাজিমুদ্দিনকে তার নিজের জমিদারিতেই হারিয়ে দিয়ে বেইজ্জত করলেন তিনি।
উজ্জ্বল জয় এলো সামনে, কিন্তু পেছনে পেছনে এলো অন্ধকার, এলো পরাজয়;
তিনি জয়ী হলেন নির্বাচনে, কিন্তু তার দলের কর্মসূচি পরাভূত হলো কর্মক্ষেত্রে। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলো না, ইতিহাস নতুন মোড় নিল না, নবযুগ আর এলো না। যে মুসলিম লীগ বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের নাম শুনে ভয়ে সাত পা পিছিয়ে গিয়েছিল, যে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব তার সঙ্গেই সন্ধি করলেন তিনি, নির্বাচনে জেতার পর; এবং যে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন তার ১১ জন সদস্যের মধ্যে দেখা গেল ৯ জনই জমিদার শ্রেণির। পরগাছা ও বাদুড়দেরই জয় হলো, শেষ পর্যন্ত।
কেন করলেন তিনি সন্ধি? কেউ বলছেন, তার কারণ কংগ্রেসি নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা। কংগ্রেস কোয়ালিশন করতে রাজী হয়নি হক সাহেবের দলের সঙ্গে।
কংগ্রেস নেতৃত্ব অদূরদর্শী ছিল না মোটেই, বরং যথেষ্ট দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে সে নেতৃত্বে, কেননা জমিদারি প্রথার অবসানের কর্মসূচিতে নিজের সমূহ সর্বনাশ সে দেখে নিয়েছে। জমিদাররা তো ছিল কংগ্রেসেরই সমর্থক, তাদের বাদ দিয়ে কংগ্রেসের চলবে কেন? কেমন করে? আর যদি কোয়ালিশনও হতো কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের, তবু তাতে আর যারই হোক কৃষকের লাভ হতো না, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ কংগ্রেসের কর্মসূচিতে ছিল না, কংগ্রেসে ওই অসুবিধার কাজে হাত দিত না, বাধা দিত। মুসলিম লীগের সঙ্গে হক সাহেব সন্ধি করলেন শ্রেণি-স্বার্থের খাতিরে। তার পক্ষে সন্ধি না করে উপায় ছিল না। না করলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। প্রজাস্বত্ব আইন ও ঋণ সালিশি বোর্ড নবযুগ আনতে পারল না দেশে। মূল ব্যাধির চিকিৎসা হলো না, উপসর্গের চিকিৎসা হলো শুধু। ভদ্রলোকরা এক কথাই বলেন, এক কথারই মানুষ তারা, সে কথা শ্রেণিবোধের কথা। বাংলার রাজনীতি আসলে বাংলার অর্থনীতি—এ কথা হক সাহেবই বলেছিলেন একদা, সে কথা দেশের রাজনীতিতে যেমন, তার নিজের রাজনৈতিক জীবনেও তেমনি সত্য।
হক সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস আজও রচনার অপেক্ষায় আছে। সে রচনার উপাদান নানা জায়গায় পাওয়া যাবে, সেগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন