

ফ্যাসিস্ট পতনের পর অভ্যুত্থানকারী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমর্থন নিয়ে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন, সংস্কার ও গণহত্যার বিচারকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। নির্দলীয় হওয়ায় সরকার কোনো বিশেষ দলের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথা নয়। কিন্তু, সরকারপ্রধান ও কয়েকজন উপদেষ্টার বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। বিশেষ করে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’র সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল ‘এনসিপি’ গঠনের পর বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সরকারের কতিপয় নীতিনির্ধারকদের সহানুভূতি ও বিশেষ সহযোগিতার কারণে এনসিপিকে কিংস পার্টির তকমা দেয় অন্য দলগুলো। সমন্বয়কদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ ও আন্দোলনকারীদের ড. ইউনূস নিয়োগকর্তা বলায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভ্যুত্থানকারী শিক্ষার্থী আন্দোলনের ইমেজ কাজে লাগাতে চায় এনসিপি। কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠনের পর তাদের মুল্যায়ন শুরু হয় নতুনভাবে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য দলগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা হয়। এতে করে এনসিপি নেতারা কখনো অভিমান, কখনোবা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকেন। মুখে নতুন রাজনীতির কথা বললেও, কার্যক্রমে পুরোনো ধ্যান-ধারণা প্রকাশ পায়। রাজনৈতিক বাহাসের সময় আন্দোলনে তাদের অবদানের কথা ও অন্যদের ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর বিপরীতে রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ বছরে তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিসংখ্যান তুলে ধরে। এমনকি অভ্যুত্থানে কোন দলের কতজন হতাহত হয়েছেন, তা নিয়ে তর্ক চলে। কৃতিত্ব ও নেতৃত্ব নিয়ে পারস্পরিক দাবি ও অবজ্ঞা মাঝেমধ্যে বিতর্ক থেকে ঝগড়ায় রূপ নেয়। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ আর অন্যকে অস্বীকার করা দেশের রাজনীতির পুরোনো ব্যাধি। এখন অভ্যুত্থানকারী দলগুলো ব্যস্ত সতীর্থ আক্রমণে। ভোটব্যাংক বাড়াতে পতিত আওয়ামী লীগকেও কাছে টানতে দ্বিধা করছে না বিপ্লবীরা। কে কতটা বিশেষ সুবিধা নিতে পারে, তাই নিয়ে চলছে উৎকট প্রতিযোগিতা।
অন্তর্বর্তী সরকার সংকটে-সম্ভাবনায় রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ নিয়ে থাকে। এজন্য যমুনায় ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের আসা-যাওয়া রয়েছে। তবে, তিনটি দলের গুরুত্ব বেশি বলে অন্যরা সমালোচনা করে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি আধাসরকারি দলের সুবিধা ভোগ করছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল তিনটির মধ্যেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। চাওয়া-পাওয়া একটু কমবেশি হলেই এক দল আরেক দলকে ‘বিশেষ দল’ বলে সমালোচনা করে থাকে। এদের মধ্যে বিএনপি সবচেয়ে বড় এবং ভুক্তভোগী দল। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। দেশজুড়ে সংগঠন, বিরাট জনসমর্থন এবং অভিজ্ঞতা থাকায় আগামী দিনে বিএনপির সরকার গঠন করবে—এ ধারণাটি প্রায় প্রতিষ্ঠিত। এ সম্ভাবনাই দলটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী দল নয়, পার্টির ভেতরেও ক্ষতিকর গ্রুপ তৈরি হয়েছে। চলনে-বলনে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো আচরণ করছে। চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে বদনাম করে ফেলেছে তারা। অপরাধের তুলনায় অভিযোগ বেশি প্রচারিত হয় বলে বিএনপি নেতারা উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এ সুযোগ তো হাতছাড়া করবে না! গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা এবং উগ্র ডানপন্থা উত্থানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় বিএনপি। এজন্য সাধারণ উদার গণতান্ত্রিক মানুষের প্রশংসা পায় তারা। যদিও এককালের মিত্র জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো বিরক্ত হয় তাতে। একই সময়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ইসলামী ও মব সৃষ্টিকারী সংগঠনও উঠে-পড়ে লাগে বিএনপির বিরুদ্ধে। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করতেও দ্বিধা করে না। এক দখলদারকে বিদায় করে আরেক দখলদারকে জনগণ ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেও প্রচারণা চালায় জামায়াতসহ অধুনা সমমনা দলগুলো। কিন্তু নিজামী-মীর কাশেম-সাকা চৌধুরীর মিথ্যা মামলায় সাজা হয়েছে বলে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বিএনপির এ অবস্থানকে স্ববিরোধী বলে মনে করে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের চরিত্র, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিত্ব আর তারেক রহমানের নেতৃত্ব থাকলে আর কিছু লাগে না। নগদ লাভের লোভে ডান-বাম না করে নিজেদের নৈতিক অবস্থান ধরে রাখলেই বিএনপি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। দল থেকে গুপ্ত জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ছেঁটে ফেলা এখন সময়ের দাবি।
বর্তমান সরকারের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দল জামায়াতকেই প্রথম সুবিধাভোগী হিসেবে মনে করেন অনেকে। সচিবালয়, বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ব্যাংক-বীমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোকজন নিয়োগে এগিয়ে আছে বলে জানা যায়। হাসিনার শেষ সময়ে নিষিদ্ধ জামায়াত ফ্যাসিস্ট আমলে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন তা সুদাসলে উপভোগ করছে। দলীয় অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করছে। এটা তাদের অনিবার্য অধিকার হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। পুরো দেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে আরও কিছু সময়ের দরকার। সেজন্য পিআর, জুলাই সনদ ও গণভোটের অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। চাহিদামতো সরকারি সহযোগিতা না পেলে অভিযোগ করেন, একটি বিশেষ দল দ্বারা প্রভাবিত সরকার। বিএনপিকে ইঙ্গিত করে এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে দলটি। তবে অতি কৌশলের কারণে কোনো কোনো উদ্যোগ বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সে ব্যাপারে ‘যদি-কিন্তু-তবে’ সহযোগে দেশ-বিদেশে একাধিকবার ক্ষমা চেয়েছে দলটি। ক্ষমা পেয়েছে কি না, নির্বাচনের পর হয়তো জানা যাবে। আপাতত ক্ষমার চেয়ে ক্ষমা চাওয়ার ধরনই বেশি আলোচিত হচ্ছে। নারীদের প্রতি কট্টর ইমেজ মুছে ফেলতে, তাদের কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টা করাসহ নানা ঘোষণা দিয়েছেন জামায়াত আমির। এতে করে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নেটিজেনরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ট্রল করছে। ধর্মীয় উদারতা দেখিয়ে ‘হিন্দু সম্মেলন’ করছে জামায়াত। এর আগে পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে ইসলামী হামদ-নাত গেয়ে সমালোচিত হয়েছে তারা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত সবসময় বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার আশা করেছে। সম্প্রতি পর্দার আড়ালে নানারকম প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে নিজেদের আগামী দিনের সরকারি দল হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আজন্ম পুঁজি ভারত বিরোধিতা থেকেও সরে এসেছে। লোকদেখানো দুয়েক কথা বললেও ভেতরে ভেতরে ভূরাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। ক্ষমতার মোহে দলগুলো নির্বাচন সামনে রেখে অর্বাচীন রাজনীতিকে স্বাগত জানাচ্ছে। যে কারণে অনেকের মতো একজন উপদেষ্টাও আশঙ্কা জানিয়েছেন, আগামী দিনের রাজনীতি হবে সংঘাতের।
জনসমর্থন ও সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনায় সরকারের কাছে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এনসিপি। যদিও নিয়োগকর্তা হিসেবে ড. ইউনূসের কাছে তাদের গুরুত্ব অন্য পর্যায়ের। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও শিষ্টাচার দেখে তাদের কেউ কেউ তিন নম্বর বাচ্চা হিসেবে সমালোচনা করে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘায়েল করার চেষ্টা করলেও শিশু বা বাচ্চা রাজনীতিবিদ হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। পটপরিবর্তনে তাদের রয়েছে বিরাট অবদান। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বর্তমানে এনসিপির অম্লমধুর সম্পর্ক। দুই দলের নেতাদের সঙ্গে তাদের আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক বাহাস এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে নির্বাচনী জোট ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রশ্নে তাদের জন্য দল দুটি সবসময় দরোজা খোলা রেখেছে। বিএনপি-জামায়াত হাইকমান্ড এনসিপির ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান ধরে রেখেছে। এ সুযোগে এনসিপির কোনো কোনো নেতা অতিপ্রগল্ভতায় বিশেষ হতে চেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। শুরু থেকেই কিংস পার্টি বা জামায়াতের বি-টিম তকমা পাওয়ায় এনসিপির বেড়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিজস্ব পরিচয়ে এগিয়ে যেতে এখন তারা মনোযোগী হয়েছে বলে মনে হয়। তবে শাপলা প্রতীক প্রাপ্তির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে, অযৌক্তিকভাবে ধানের শীষ নিয়ে টানাটানি করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিচারালয়ের প্রতীক জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করায় এনসিপির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। আগামী দিনে ভিত্তি শক্তিশালী করতে তারা হয়তো আরও সতর্ক হয়ে পথ চলবে। নেতা বা দলগুলো কাজের মাধ্যমেই বিশেষ হয়ে ওঠে। বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে জনপ্রিয় হওয়া যায় না। অতীতে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ ও দল অতি আত্মবিশ্বাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু আত্মত্যাগ বা দেশপ্রেম প্রদর্শনই শেষ কথা নয়। দেশ ও জনকল্যাণে দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিনিয়ত। জনআস্থা অর্জন করতে না পারলে মহান উদ্যোগও আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে আমজনতা। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা না পেলে অসাধারণ পরাশক্তির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাও টেকে না। বারবার প্রমাণিত এ সত্য বুঝতে পারাটাই শাসক ও রাজনীতিবিদদের সফলতার মূল মন্ত্র।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন