

‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো/ দুটি দিকে গেছে বেঁকে/ তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি/ আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে...’। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এ গানটি কালজয়ী হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হারানো সুর’ সিনেমায় সংযোজিত করা হয়েছিল। গানটি সৃষ্টির পর চলে গেছে প্রায় সাড়ে ছয় দশক। কিন্তু এর আবেদন এতটুকু কমেনি। এখনো এ গানের কথা ও সুর এবং হেমন্তের গায়কি শ্রোতাকে আপ্লুত না করে পারে না। এই পথ বেঁকে যাওয়ার বিষয়টি বড়ই বেদনাদায়ক। একসঙ্গে চলতে থাকার পর যখন একে অন্যকে ছেড়ে ভিন্ন পথে হাঁটা ধরে, তখন বিষণ্নতা গ্রাস করে উভয়কেই। তবে পথের ধর্মই হলো বাঁক নেওয়া। চলার পথে মোড় বা বাঁক থাকবেই। যারা একসঙ্গে পথ চলতে চান, তাদের সে পথের বাঁকও একসঙ্গে অতিক্রম করতে হয়। আর তা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের একসঙ্গে চলার মানসিকতা ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা থাকতে হয়। তা না হলে, একসময় না একসময় বিচ্ছিন্নতা এসে চলার পথ পৃথক করে দেয়।
রেললাইন সমান্তরাল বয়ে গেলেও তা কিন্তু মোড় নেয় বিভিন্ন স্থানে। আর সেটা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছার সুবিধার্থেই। আর সড়ক বা মাটির রাস্তায় বাঁক সৃষ্টি হয় নির্মাণজনিত সুবিধা-অসুবিধাকে মাথায় রেখে। স্কুলজীবনে বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছি, প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে বা রেলের চাকার ঘষায় রেললাইনের পাতের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। এর ফলে রেললাইন বেঁকে যেতে পারে। এজন্য রেলপাতের দৈর্ঘ্য কোনো কারণে বেড়ে গেলেও যাতে লাইন বেঁকে না যায়, সেজন্য দুই পাতের সংযোগস্থলে কিছুটা অংশ ফাঁকা রাখা হয়। যাতে রেলের চাকার ঘর্ষণ বা রৌদ্রতাপে পাতের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেলেও লাইন বেঁকে না যায়।
তবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কিন্তু রেললাইনের বেঁকে যাওয়া নিয়ে গানটি রচনা করেননি। তার গানের উপজীব্য হলো দীর্ঘদিন একসঙ্গে জীবনের পথচলার পর প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ বা পথবদল। এটা সচরাচর ঘটে থাকে। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেই নয়, এ সমাজ-সংসারে এমনতর বিচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর সেজন্যই এ গানটি আজও পুরোনো হয়নি। কিন্তু আমার বিষয় রেললাইন বা প্রেমিক-প্রেমিকার পথচলা বেঁকে যাওয়া নয়, আমি তো রাজনীতির ঢেঁকি। তাই গান শুনতে গেলেও সেখানে রাজনীতির মালমসলা তালাশ করি। ছুটির বিকেলে হেমন্তের এ গানটি শুনতে শুনতে মনটি বিষণ্ন হওয়ার পরিবর্তে হুট করে প্রবেশ করল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে; যেখানে প্রায় এক বছর একসঙ্গে পথচলা রাজনৈতিক দলগুলোর পথ বেঁকে যেতে বসেছে।
ভাবনাটি অবশ্য সকাল থেকেই মাথায় বাসা বেঁধেছিল। সকালে (২৪ অক্টোবর) দৈনিক কালবেলার প্রধান শিরোনাম দেখেই মাথার মধ্যে সুর বাজছিল ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। কালবেলার ওই প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘যার যার পথে হাঁটছে দলগুলো’। অর্থাৎ, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যেসব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে হাঁটছিল, এখন তাদের পথ ‘আলগ’, মানে পৃথক হয়ে গেছে। কালবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ অক্টোবর ২৫টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও রাজৗনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা কাটেনি। সনদ স্বাক্ষরের পর একটি নতুন বাংলাদেশের শুভ সূচনার যে আশা করা হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। সনদ স্বাক্ষরিত হলেও এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য। অবশ্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে বের করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক অব্যাহত রেখেছে।
এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। তারা নির্বাচন বিষয়ে তাদের দাবি ও নিজ নিজ অবস্থানের কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছে। বিএনপি সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে অনুষ্ঠানের পক্ষেই তাদের অবস্থান রাখছে। উপরন্তু সম্প্রতি তাদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোলিং অফিসার কারা হবেন, কীভাবে নির্বাচন পরিচালনা হবে সেসব বিষয়ে দলীয় অভিমত তুলে ধরেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এখনো সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবিতে অটল রয়েছে। দলটি এটাও বলেছে, তাদের দাবি মানা না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক মতবিনিময় সভায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘একটা নির্বাচনের আগে আরেকটা নির্বাচন খুবই যৌক্তিক। ওইদিন যদি নির্বাচন হয়, তাহলে কীসের ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে মানুষ জানবে না।’ তিনি নভেম্বরের মধ্যে গণভোট অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া দল এনসিপি শাপলা প্রতীক না পেলে নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের অনাস্থার কথা পুনরায় ব্যক্ত করেছে। তারা মনে করে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। তবে ইসি কাদের পক্ষে কাজ করছে, সে কথা তারা পরিষ্কার করেনি।
কালবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সনদ স্বাক্ষরের পর এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলেও দলগুলোর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফলে যথাসময়ে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা বারবার আশ্বস্ত করছেন, নির্বাচন ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবস্থান ও মতদ্বৈধতা এ ক্ষেত্রে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। যদিও সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং জুলাই সনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত জনকাঙ্ক্ষিত সে ভূমিকা পালন করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই। যেখানে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের চেয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দলীয় স্বার্থ সবসময় বড়, সেখানে বিদ্যমান অনৈক্য দূর হওয়া অনেকটাই সুদূরপরাহত।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, আওয়ামী লীগের পতন-আন্দোলন এবং পতন-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক বিশ্বাস, সৌহার্দ্য ও সহনশীলতা দেখা গিয়েছিল, এখন তা হারিয়ে যেতে বসেছে। আর এর কারণ যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থপরতা, তা না বললেও চলে। বিশেষত আওয়ামী লীগের পতন-পলায়নের পর জামায়াতে ইসলামীর একক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার উদগ্র বাসনা এবং সেজন্য ধরাকে সরাজ্ঞান করে অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সিংহভাগ দায়ী। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে প্রচারের প্রয়াস পেয়েছে, যেন বিএনপি সারা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উদ্দেশ্য, জনসাধারণের কাছে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অথচ এসব বিষয়ে দল হিসেবে বিএনপি কিংবা নেতা হিসেবে তারেক রহমান অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। চাঁদাবাজি, দখলসহ যে কোনো অপরাধের অভিযোগে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখভাগে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা এনসিপি মনে করেছিল, যেহেতু তারাই হাসিনাকে তাড়িয়েছে, তাই তারা যেটা বলবে সেটাই প্রতিপালিত হবে। এ অহমিকা থেকে তারা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা এখন তাদের ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। একসময় যারা ছিল তাদের পরম বন্ধু, তারা পরিণত হয়েছে শত্রুতে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ১৫ বছরের লীগ দুঃশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও দলগুলোর বোধোদয় ঘটেনি। তারা বিস্মৃত হয়েছে, অনৈক্যই ধ্বংসের বীজকে উপ্ত করে। জুলাই আন্দোলনের পক্ষশক্তির মধ্যে যে কোনো বিভেদ-অনৈক্য যে পরাজিত অগণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তি জোগাবে, এটা তারা বুঝতে পারছে না। একটু খেয়াল করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, পতিত অপশক্তিটি সর্বদা সুযোগ খুঁজছে রাজনীতির মাঠে পদচারণার। সম্প্রতি ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার পরদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ কর্মীদের মিছিল তারই প্রমাণ।
অন্যদিকে কোনো কোনো মহল থেকে গণতন্ত্রের কথা বলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ যেভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধর্ষণ করেছে, তাতে সে অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা তারা রাখে কি না, এ প্রশ্ন কেউ তুলছে না। যারা ভোটারবিহীন, রাতের অন্ধকারে ভোট-বাক্স ভরা ও ব্যালট লুটের কেলেঙ্কারির পরপর তিনটি নির্বাচন করেছিল, শাস্তি ভোগ না করে তারা কি এত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে পারে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা, খুন-ধর্ষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং নিজেরাও একই অপরাধ করায় স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তেমনি ১৫ বছর বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করে পদতলে পিষ্ট করার অপরাধে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগর রাজনীতি করার অধিকার রাখে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। আজ যারা গণতন্ত্র, মানবাধিকারের দোহাই দিচ্ছেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তারা কেন চুপ করেছিলেন?
এ প্রসঙ্গে বারান্তরে বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রইল। এখন শুধু এটুকু বলতে চাই, জুলাই আন্দোলনের পক্ষশক্তিকে বুঝতে হবে, তাদের অনৈক্যের সুযোগে পতিত আওয়ামী লীগ কচ্ছপের মতো খোলস থেকে মাথা বের করার চেষ্টা করছে। দলগুলোর এহেন মনোবৃত্তির কারণে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা ঐক্যের পথ ছেড়ে যেভাবে বিভক্তির পথে হাঁটা দিয়েছে, তা দেশকে নিয়ে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়ের দিকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন