

সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর গাজায় যে অস্থিতিশীল শান্তি কায়েম করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীজুড়ে যেন দুটো আলাদা সংলাপ চলছে—একটি নিঃশব্দ, বাস্তববাদী এবং আঞ্চলিক; অন্যটি উচ্চকণ্ঠ, নৈতিক এবং বিশ্বজনীন। প্রথমটি গোপন কক্ষের আলোচনায় সীমাবদ্ধ—কূটনীতিকদের, গোয়েন্দা সংস্থার এবং মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দূরদর্শীদের মাঝে। আর দ্বিতীয়টি উচ্ছ্বসিত মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত বিক্ষোভে, সামাজিক মাধ্যমে, মানবতার পক্ষের আকুতি ও ক্ষোভে। একদিকে ক্ষমতার পালাবদলের নতুন মানচিত্র আঁকা হচ্ছে, অন্যদিকে উচ্চারিত হচ্ছে ছলচাতুরী ও অবিশ্বাসের গল্প।
তবে যারা নীরবে শোনে, তাদের কানে এখন এক গভীর বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে, গাজা নিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়েছে; শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, রাজনীতির অঙ্গনেও। কূটনৈতিক হিসাব কষলে দেখা যাবে, এ দ্বন্দ্বটির পুরোনো অধ্যায়ে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। বর্তমানের অধ্যায়টা শুধু যুদ্ধবিরতির নয়, বরং একই সঙ্গে একটি নতুন পুনর্বিন্যাস ব্যবস্থার, যা গাজার ভবিষ্যতের পাশাপাশি ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি রাজনীতি এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতার অর্থকেই বদলে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।
এ নতুন অঙ্কে হামাস ও বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক ইসলামের সব প্রকল্প ধীরে ধীরে বহিষ্কৃত হবে মূল ধারার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাশালী, যারা এখন স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও নিয়ন্ত্রিত আধুনিকায়নের পতাকাতলে একত্রিত, তারা এমন আন্দোলনগুলোকে অতীতের ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করে। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থি দলগুলোর সামরিক ও রাজনৈতিক গতিবিধি অরাজকতার বাহক এবং অগ্রগতির শত্রু। তাই এখনকার ঐকমত্য হলো, এদের হয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নয়তো নিঃশেষ করতে হবে।
এই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ধারণা কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিম তীরেও ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, নতুন আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার মূলনীতি এখন ‘শাসনযোগ্যতা’। এ ভূখণ্ডকে নিয়ে পরিকল্পনাটি বেশ স্পষ্ট। সেটা হলো, কয়েকটি আরব দেশ এবং সঙ্গে কিছু ইসলামী ও আন্তর্জাতিক শক্তি, পশ্চিম তীরকে সাময়িক তত্ত্বাবধানে নেবে প্রশাসনিক, আর্থিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে যাতে একটি ‘যথাযথভাবে পরিচালিত’ পরিবর্তনের পথ তৈরি হয়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে শেষ সুযোগ নিজেদের পুনর্গঠন ও সংস্কার করার এবং তাদের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার। এজন্য নিযুক্ত করা হবে স্বাধীন টেকনোক্র্যাটদের একটি দল, যেটি প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন, গাজা প্রশাসন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি তদারকি করবে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অনীহা দেখালে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে; এমনকি, তাদের দেউলিয়া করে দেওয়ার উদ্যোগও নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন যে, এটি কোনো সংস্কার নয়, বরং সহায়তার নামে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। বাস্তবতাও কিছুটা তাই, কারণ এ পরিকল্পনা গণতান্ত্রিক উদ্দীপনা থেকে নয়, বরং ‘নিয়ন্ত্রিত স্থিতি’ সৃষ্টির বাসনা থেকে উদ্ভূত। তবে তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য একটাই,Ñএমন একটি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যা একই সঙ্গে জনরোষ সামলাতে এবং পূর্বনির্ধারিত ভাষায় আলোচনায় অংশ নিতে সক্ষম। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কিছু দেশের মতো ফিলিস্তিনে নেই রাজতন্ত্র বা বংশানুক্রমিক শাসনের রীতি। কাজেই, বহিরাগত হিসাব-নিকাশ থেকে সিদ্ধান্ত হলেও, গণতন্ত্রই একমাত্র উপায় অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার।
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন (পিএলও), যা একসময়ে জাতির অনুপ্রেরণা ছিল, তা আজ প্রায় এক খোলসমাত্র। মুক্তির স্লোগান এখন পরিণত হয়েছে ঘোষণায়, আবেদনপত্রে আর দাতাদের অর্থের আশায়। নতুন আঞ্চলিক কাঠামোয় এ সংগঠনকে অনেকে মনে করছে সময়োত্তীর্ণ এক স্মৃতিসৌধ, যেখানে বিপ্লবের অগ্নি নিভে গেছে। তারা যদি প্রাসঙ্গিক থাকতে চায়, তবে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জন্য তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে; বিপ্লবী চেতনার মোহ ত্যাগ করে বাস্তববাদী পোশাকে ফিরে আসতে হবে।
গাজা এবং বৃহত্তর অর্থে ফিলিস্তিনকে নিয়ে এ রূপরেখা এখন মধ্যপ্রাচ্যের নীতি-অঙ্গনে ‘অপরিহার্য ভবিষ্যৎ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেউ খোলাখুলি বলছে না, কিন্তু আম্মান থেকে কায়রো, রিয়াদ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি—নীরবতা এবং আত্মবিশ্বাস বজায় রেখে সবাই যেন এক পথেই এগিয়ে চলেছে। গাজা সংকট নিরসন করতে তারা সফল হবে বলেই তাদের বিশ্বাস।
কিন্তু সেই উদ্দেশ্য হাসিল করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। ভেতরের কক্ষগুলোতে যেখানে ‘শৃঙ্খলা’, ‘পর্যবেক্ষণ’ ও ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর ভাষার ব্যবহার চলছে, বাইরের পৃথিবী সেখানে শুনতে পারছে ‘চক্রান্ত’, ‘বেইমানি’ ও ‘নৈতিক অবক্ষয়ের’ সুর। আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনগুলো এবং গাজার পক্ষে লড়াই করে যাওয়া মানবাধিকারকর্মীরা এ পুনর্বিন্যাসকে দেখছেন এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে। তাদের ভাষ্যমতে, ক্ষমতার এ পুনর্বণ্টনে নেই ন্যায়, নেই জবাবদিহি, নেই কোনো সৎ ও সংহত দর্শন। তাদের চোখে এটি সংস্কার নয়, বরং এক প্রকার আত্মসমর্পণ। তারা ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না; আবার সন্দেহ করছে সেই আঞ্চলিক সরকারগুলোকেও, যারা অর্থ ও প্রভাবের টানে নতুন সমীকরণের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিচ্ছে।
এ সংশয়গুলো মোটেও ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু তারপরও, সরলতা ও নৈরাশ্যের মাঝখানে এক বাস্তববাদী স্থানে দাঁড়াতে হবে—যে বাস্তববাদ আত্মসমর্পণের নয়, বরং সচেতনতার। কারণ যা ঘটছে, তা ন্যায়বিচারের পরিপূর্ণতা নয়; বরং সেই কাঠামোর জন্মক্ষণ, যার ভেতরে ভবিষ্যতের ন্যায় বা অন্যায়ের পরিধি নির্ধারিত হবে। একে উপেক্ষা করা মানে আবারও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারানো।
গাজার এ আমূল পরিবর্তন লেভান্ত অঞ্চলে রাজনীতির ব্যাকরণকেই পাল্টে দিয়েছে। ইসরায়েলি শক্তি, যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন, তা আপাতত তার সর্বগ্রাসী আচরণের ওপর লাগাম টেনে ধরেছে। আঞ্চলিক রাজনীতি এক নতুন রূপ নিচ্ছে; রচনা করা হচ্ছে এক নতুন ব্যবস্থা। যে জাতি এর ভাষা শিখবে না, সে ইতিহাসে টিকে থাকবে না—সময়ের প্রান্তে ভুলে যাওয়া এক অধ্যায় হয়ে রয়ে যাবে।
বাস্তবতা ও নৈতিকতার এ দুই প্রবাহ এখন পাশাপাশি বয়ে চলেছে—সংঘর্ষে ও সংলাপে। একদিকে ইসরায়েলের অনন্ত সম্প্রসারণবাদী প্রকল্প, যা প্রতিনিয়ত শান্তি, ন্যায় ও স্থিতির প্রতিটি উদ্যোগকে ধ্বংস করেছে; অন্যদিকে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বাস্তববাদী জোট, যারা প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে।
অদূর ভবিষ্যতে এ দুই স্রোতের সংঘর্ষ অনিবার্য অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, যখন ওয়াশিংটন ডিসির দৃষ্টি অবশ্যম্ভাবীভাবে সরে যাবে চীন ও রাশিয়ার দিকে এবং যখন পশ্চিমা গণমানুষের বিবেক জেগে উঠবে ইসরায়েলের শাস্তি ও জবাবহীন ঔপনিবেশিক নীতিগুলোর বিরুদ্ধে, তখনো এ বাস্তববাদী আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাব টিকে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। তখন হয়তো আঞ্চলিক প্রচেষ্টায় কিছু স্বাধীন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে সংহতির কণ্ঠগুলো কথা বলতেই থাকবে নৈতিকতার ভাষায়—অধিকার, স্মৃতি এবং সেই চিরন্তন ন্যায়বোধে, যা দ্রুতগামী রাজনীতির যুগেও হার মানে না। তাদের কণ্ঠ অপরিহার্য; তারা সেসব স্মরণ করায়, যা রাজনীতি ভুলে যায়। ইতিহাস কখনোই নিজের থেকে ন্যায়ের পথে বাঁক নেয় না—তাকে পরিচালিত করতে হয়, স্মৃতি ও সাহসের হাত দিয়ে সঠিক পথে টেনে আনতে হয়।
বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী ফিলিস্তিনিরা এবং গাজাবাসীর পক্ষে যারা মানবিক সংহতিতে উদ্বুদ্ধ, তাদের কাজ এখন স্পষ্ট। তাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে সাময়িক স্বীকৃতি, প্রস্তাব বা পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি এসব সংঘর্ষ প্রশমনের উপহার, দেশীয় কিংবা আঞ্চলিক ব্যবস্থা রূপান্তরের নয়। এগুলো গ্রহণ করা যায়, কিন্তু এগুলোকে ভুল বোঝা চলবে না।
পরিবর্তনের প্রকৃত শক্তি নিহিত আছে নিরবচ্ছিন্ন চাপ বজায় রাখার মধ্যে। যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের আইনের মুখোমুখি করতে হবে; প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং ন্যায়বিচারের অর্থ পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে। যতদিন এই তাগিদ বেঁচে থাকবে, ততদিন বিবেক জীবিত থাকবে রাজনৈতিক এক শক্তি হিসেবে। আর ফিলিস্তিনের সংগ্রাম চলতে থাকবে; শুধু একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য নয়, বরং একই সঙ্গে আমাদের সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাফল্যের একটি নিদর্শন হিসেবে।
তবে সবচেয়ে কঠিন কাজটি এখনো আদায় করা বাকি রয়ে গেছে ফিলিস্তিনের জন্য নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা। গাজার ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে আসা এ অনিশ্চিত কিন্তু বাস্তব শূন্যতা পূরণ করতে হবে। কেউ আমন্ত্রণ জানাবে না; এ দায়িত্বগুলো পূরণ করতে হবে ফিলিস্তিনিদের নিজেদেরই—সাহস, স্বচ্ছতা ও সংগঠনের মাধ্যমে। ফিলিস্তিনের পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝতে হবে, শুধু সাক্ষ্য দেওয়া বা প্রতিবাদ করা যথেষ্ট নয়। নেতৃত্বের আসন কেউ উপহার দেবে না; সেটি দাবি তুলে দায়িত্বের সঙ্গে আদায় করে নিতে হবে।
ফিলিস্তিন এখন আবারও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে। সবাই নতুন নেতৃত্ব দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। তাই তাদের শরণার্থীশিবিরের তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে মাঠে নামতে হবে; নীতিনির্ধারণে, সংগঠন গঠনে এবং পরিবর্তন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন খুঁজতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, শুধু নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের মাধ্যমেই ফিলিস্তিন তার কণ্ঠ ফিরে পাবে; ইতিহাসের এ নতুন অধ্যায় রচনা করে নতুন যাত্রা শুরু করবে।
লেখক: লন্ডনভিত্তিক লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেসরকারি সংস্থা ‘ওপেন বেথেলহেম’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী কর্মকর্তা। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন