ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হতে হবে

চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হতে হবে

আল্লাহ মানুষকে জীবিকার জন্য অসংখ্য পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, আল্লাহ মানুষের রিজিকের ৯০ শতাংশ রেখেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে, আর মাত্র ১০ শতাংশ রেখেছেন চাকরি ও অন্যান্য পেশায়। কিন্তু বাস্তবে আজকের বাংলাদেশে প্রায় ১০০ শতাংশ তরুণই জীবিকার উৎস হিসেবে সেই ১০ শতাংশের মধ্যেই রিজিক খুঁজছে। অর্থাৎ, আমরা রিজিকের প্রকৃত উৎস থেকে দূরে সরে গিয়ে সীমিত ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ এক পথে ছুটে চলেছি, যা কোনোভাবেই টেকসই বা সফলতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই আজ অধিকাংশ তরুণের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় একটি ‘ভালো চাকরি’ পাওয়া। সরকারি চাকরির জন্য বিসিএস, ব্যাংক, এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় তারা বছরের পর বছর সময় ব্যয় করে। অথচ একই সময়ে যদি তারা নিজেদের উদ্যোগে কিছু শুরু করত, তাহলে হয়তো নিজেদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি অন্যদেরও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত। এদিকে যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তারা ছুটে যাচ্ছে বিদেশে—নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী বা অন্যান্য পরিশ্রমসাধ্য কিন্তু কম পারিশ্রমিকের কাজে যুক্ত হতে। তাদের পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকলেও, বিদেশ বিভুঁইয়ে একাকিত্ব, কষ্ট ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের জীবনের বড় এক মানসিক মূল্য দাবি করছে।

এ পরিস্থিতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি এক মানসিকতার সংকট। সমাজ ও পরিবার তরুণদের শেখাচ্ছে—‘ভালো চাকরি পাওয়াই জীবনের সফলতা’। ফলে উদ্যোক্তা হওয়া মানে ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও ব্যর্থতার সম্ভাবনা—এমন ধারণা আমাদের চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো জাতি কেবল চাকরির ওপর নির্ভর করে আত্মমর্যাদাশীল বা সমৃদ্ধ হতে পারেনি। সমাজে নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন ও অগ্রগতির পথ খুলে দেয় উদ্যোক্তারা—যারা নিজের হাতে কাজ তৈরি করে, অন্যদের কাজের সুযোগ করে দেয়।

আমাদের এ চাকরিনির্ভর মানসিকতার মূল শিকড় ঔপনিবেশিক যুগে। ব্রিটিশ শাসকরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার বদলে আদেশ মানা কর্মচারীতে পরিণত করেছিল। সে ঐতিহ্য আজও টিকে আছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য এখনো চাকরির প্রস্তুতি, উদ্যোগ বা সৃজনশীলতা নয়। ফলে সমাজে এখনো মনে করা হয়—চাকরি মানে নিরাপত্তা, ব্যবসা মানে অনিশ্চয়তা। এ ধারণাই ধীরে ধীরে আমাদের আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও সাহসকে নিঃশেষ করছে।

চাকরি মানে অনেকের কাছে নিরাপত্তা, কিন্তু বাস্তবে এটি প্রায়ই নির্ভরতার প্রতীক। একজন মানুষ যখন অন্যের নির্দেশে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ নির্ভরতাই একটি জাতিকে দুর্বল করে তোলে। আজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক তরুণ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশের লক্ষ্য কেবল চাকরি। নতুন কিছু উদ্ভাবনের, সমাজে পরিবর্তন আনার বা নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তোলার মানসিকতা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

অর্থনীতির ভাষায় বেকারত্ব বলতে বোঝায় কর্মক্ষম মানুষ কাজ না পাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি এক মানসিক বেকারত্ব। আমরা কাজ তৈরি করার বদলে কাজ খুঁজতে শিখেছি। ফলে জাতি আত্মবিশ্বাস হারায়, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং নির্ভরতার চক্রে বন্দি হয়ে পড়ে। এ মানসিক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসলাম পরিশ্রম, উদ্যোগ ও আত্মনির্ভরতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। নবী করিম (সা.) নিজেও ছিলেন এক বিশ্বস্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবসায়ী, যিনি তার সততা ও আস্থার কারণে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন। ব্যবসা-বাণিজ্য কেবল জীবিকার উপায় নয়, এটি ইবাদতেরও এক রূপ—যদি তা সততা, ন্যায় ও মানবকল্যাণের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। হাদিসে এসেছে—‘উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম’। অর্থাৎ, যে দান করে, সে উত্তম; যে গ্রহণ করে, সে নিম্নতর। চাকরির ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই নিচের হাত হয়ে থাকি—অন্যের অনুমতি, অন্যের মর্জি ও অন্যের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু উদ্যোক্তা হলে আমরা নিজের সঙ্গে অন্যের জীবিকাও সৃষ্টি করতে পারি। এটি একদিকে ইবাদত, অন্যদিকে সমাজকল্যাণের পথ।

চাকরিনির্ভর মানসিকতা ভাঙতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো আমাদের পাঠ্যক্রম পরীক্ষাভিত্তিক; সেখানে উদ্যোক্তা শিক্ষা বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারণা প্রায় অনুপস্থিত। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কীভাবে নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কাজ তৈরি করা যায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘উদ্যোক্তা ক্লাব’ গঠন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্র প্রকল্প হাতে নেবে, বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এবং উদ্যোগী হতে শিখবে। একই সঙ্গে পরিবারকেও মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে—‘চাকরি নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ হবে নতুন সাফল্যের মাপকাঠি।

আমাদের সমাজ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়—এটি চিন্তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত মানসিক ব্যাধি। মুক্তির একমাত্র পথ হলো মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে, রিজিক আল্লাহর হাতে, কিন্তু উদ্যোগ আমাদের হাতে। যদি আমরা সেই ৯০ শতাংশ রিজিকের পথে—অর্থাৎ ব্যবসা, উৎপাদন ও সৃজনশীল উদ্যোগের পথে—ফিরে যেতে পারি, তাহলে বেকারত্ব শুধু কমবেই না, বরং আমরা স্বাবলম্বিতা, আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাব।

এখন প্রয়োজন এমন এক তরুণ প্রজন্ম, যারা চাকরি খোঁজার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কাজ তৈরি করার মানসিকতা অর্জন করবে। তাহলেই ‘বেকারত্ব’ শব্দটি একদিন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে, বাস্তব জীবনে নয়।

লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিদ্যালয়ে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা হবে : আমিনুল হক

শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে ‘দুঃসংবাদ’

চীন থেকে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে বাংলাদেশ

বিলম্বের চেষ্টা মানেই নির্বাচন বানচালের নীলনকশা : জবি শিবির

সেই মোদাব্বেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বিএনপি নেতা সালাম

দেশে গুডউইর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

রাশিয়ার সঙ্গে একগুচ্ছ পারমাণবিক স্থাপনা বানাবে ইরান 

‘মথ’ ডালে রঙ মিশিয়ে মুগ ডাল হিসেবে বিক্রি, অতঃপর...

নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেনার সময় যে ৫ ভুল করেন অধিকাংশ মানুষ

বিশ্ব ইজতেমা কবে, জানালেন কেফায়াতুল্লাহ আজহারী

১০

কোহলিকে পেছনে ফেলার সুযোগ বাবর আজমের সামনে

১১

গণপিটুনিতে নিহত ৩ জনের পরিচয় মিলেছে

১২

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা নিয়ে অবস্থান জানাল ইরান

১৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মার্কেটে ভয়াবহ আগুন

১৪

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতি সিইসির বিশেষ আহ্বান

১৫

আলু নিয়ে বিপাকে কৃষক

১৬

আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া নয়, বিশ্বের সবচেয়ে দামি পর্যটন ভিসা ছোট্ট এক দেশের

১৭

স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় স্বামী নিহত

১৮

প্রাথমিকের সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক পদ বাতিল

১৯

২৭ নভেম্বরেই জকসু নির্বাচন চায় আপ বাংলাদেশ

২০
X