দেশের ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য নতুন নয়। বছরের পর বছর বাজারের ওপর এই অসৎ শ্রেণির নিয়ন্ত্রণের লাগাম টানতে সমর্থ হননি সংশ্লিষ্ট কেউই। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নানা রকমের উদ্যোগ, পদক্ষেপ যেমন নিতে দেখা গেছে, আবার একইভাবে সেসব পদক্ষেপকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ব্যর্থতা, উদাসীনতা ও অদক্ষতা। কখনোবা এ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্যে অপারগতা অথবা অসহায়ত্বের উচ্চারণের সাক্ষী হয়েছে দেশের মানুষ। কোনো কিছুতেই বাজার থেকে দূর হয়নি সিন্ডিকেট নামের ভূতের আসর।
এ ভূতেরা দেশজ উৎপাদিত অথবা আমদানিকৃত যে কোনো পণ্যেরই নির্বিচারে দাম বৃদ্ধি করে। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে প্রায় সব পর্যায়ে রয়েছে এর লঙ্ঘন। মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে পণ্যগুলো দরকার হয়, তার মধ্যে আলু-ডিম-পেঁয়াজ অন্যতম। এ তিনটি পণ্যও সিন্ডিকেটের কবলে। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই হিসেবে এবার বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রথমবারের মতো এ তিনটি কৃষিপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতিটি ফার্মের ডিম ১২, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা। বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ তিন পণ্যের দাম বেঁধে দেন। আমরা এ উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই।
ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, উৎপাদক, পাইকারি এবং খুচরা পর্যায়ের খরচ ও মুনাফা বিবেচনায় নিয়েই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে কারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ বেশি মুনাফা লাভের জন্য অবৈধভাবে পণ্য মজুত রাখে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য নির্ধারিত দামে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ছাড়াও কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মাঠে একযোগে কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
আমরা জানি, বিশ্বে খাদ্যপণ্যের মূল্য গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও বাংলাদেশে এ চিত্র উল্টো। দেশের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় প্রায় সব খাদ্যপণ্যে নানা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এসব সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যও অস্বাভাবিক মূল্যে কিনতে হচ্ছে জনসাধারণকে। এর ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত এক দশকের সর্বোচ্চ অবস্থানে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল ও চিনির মতো খুচরা পর্যায়ে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দামও নির্ধারণ করতে বাধ্য হলো সরকার।
আমরা মনে করি, শুধু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেই চলবে না। কেননা আমরা অতীতেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যকে থোরাই কেয়ার করার প্রবণতা কম দেখিনি। এমনকি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাই ব্যর্থ হয়েছে কার্যকরী ভূমিকা পালনে। মাঝেমধ্যে বাজারে অভিযান চালিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের নামমাত্র জরিমানা করলেও পণ্যমূল্য বাড়াতে যেসব সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দুর্বলতার সুযোগই বারবার নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটমুক্ত করতে সরকারের একটি নিজস্ব শক্তিশালী বিকল্প জোগান ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। পাশাপাশি দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে বাজার তদারকি বাড়ানোসহ কৃত্রিম সংকটে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন