সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনে চাই নতুন দল

আরও এক বিএনপি। নাম তৃণমূল বিএনপি। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গড়া এই দলের জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলে নতুন কমিটি ঘোষিত হয়েছে। এই দলে যোগ দিয়েই দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে এসেছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার। শমসের তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন আর তৈমূর দলটির মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদাকে দলটির নির্বাহী চেয়ারপারসন নির্বাচিত করা হয়েছে। খবরটি এটুকুই, কিন্তু এর তাৎপর্য রয়েছে। কারণ দলের সঙ্গে বিএনপি নামটি রয়েছে। এটি কি আরেক বিএনপি? বিএনপি ভেঙে আরেক বিএনপি হয়েছে? ঠিক তেমনটি নয়। আবার এই দলের রাজনৈতিক আদর্শ বিএনপির আদর্শের সঙ্গে মিল রেখেই। শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। আর তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। দলের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

নামে বিএনপি, শীর্ষ নেতারাও বিএনপির। তবে শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, তৃণমূল বিএনপি একটি স্বাধীন রাজনৈতিক দল। এই দলের চিন্তাভাবনা নিজেদের এবং নিজ থেকেই বলেছেন, এটি কিংস পার্টি নয়, জনগণের পার্টি। কিংস পার্টি গঠিত হয়েছিল এক-এগারোর সময়। অন্যদিকে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, বিএনপি তাকে বহিষ্কার করার পর দেড় বছর অপেক্ষা করেছেন। তৃণমূল বিএনপি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হবে না। এখানে কাউকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করা হবে না।

অর্থাৎ তার আগের দল বিএনপি একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এবং সেখানে তিনি অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন। এরকম কথা শমসের মবিন চৌধুরীর বেলায়ও শোনা যায়। পিতার সহযোদ্ধা, মায়ের কাছের মানুষ হলেও তারেক রহমান তার সঙ্গে অসম্মানসূচক কথা বলতেন। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃণমূল বিএনপি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পায়। তখন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বেঁচে ছিলেন।

বাংলাদেশে দল ভেঙে নতুন দল হওয়া নতুন নয়। তবে সব ভাঙা দল সাফল্য পায় না। বিশেষ করে দেখা গেছে, বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে যারা বেরিয়ে গেছেন বা বের করে দেওয়া হয়েছে, তারা পরবর্তীকালে সফল হতে পারেননি। দল গড়া বা নিজেকে আলাদা করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা—কোনোটিতেই সাফল্য আসেনি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সাধারণত দল ভাঙার এ খেলাটা খেলে থাকত সামরিক সরকারগুলো। কিন্তু এখন কোনো সামরিক সরকার ক্ষমতায় নেই। ফলে এখানে নতুন দলে বর্তমান সরকার বা সরকারি দলের হাত আছে, সেটা বলা কঠিন।

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর নির্বাচন করতে। এমন এক নির্বাচন, যেটি হবে অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না—এমন ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের মাঠে আছে বিএনপিসহ ৩০টিরও বেশি দল। এসব দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ। ফলে সবকিছু মিলিয়ে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ আগামী নির্বাচন। শমসের মবিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। পরে দেশের কূটনৈতিক পেশায় সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন এবং অবসরে গিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে। তিনি খালেদা জিয়ার প্রিয়ভাজন ছিলেন এবং আস্থাবান ছিলেন বলেই বিএনপির মতো একটি বড় দলের ভাইস চেয়ারম্যান হতে পেরেছিলেন। তবে দলের নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার বড় ছেলের হাতে গেলে বিষয়টি তার জন্য সুখকর হয়নি। অন্যদিকে তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জের জনপ্রিয় নেতা হয়েও সেখানকার সিটি বা সংসদ নির্বাচনে তিনি দল থেকে মর্যাদা পাননি। তাই নির্বাচনের ঠিক আগে আগে বড় গতিতে নতুন দল গড়লেন তারা। সঙ্গে আছেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কন্যা। টাটকা নবাগত এই দল। নিজের সাবেক দল ছেড়ে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাইরে পা রাখলেন তারা। বলছেন, ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন।

কে কোন রাজনীতি করবেন, কোন দল কাকে নেবে বা নেবে না, সেটা নিশ্চয়ই ঠিক করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে এবং যখন সেই নির্বাচন নিয়ে নানা রসায়ন রাজনীতির মাঠে তখন হঠাৎ একটি দলের নিবন্ধন পাওয়া, সম্মেলন হওয়া এবং পূর্ণ কমিটি হওয়া ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে কি এই দল বিরোধী অবস্থানে থেকে হতে চলেছে আওয়ামী লীগেরই সহযোগী? যদি তা হয়, তাহলে জাতীয় পার্টির স্থান কোথায় হবে? ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বেঁচে থাকতেই বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনটাই আসল। প্রশ্নটা হচ্ছে, তারা নির্বাচনে যাবেন কি বর্তমান ব্যবস্থায় না তত্ত্বাবধায়কের অধীনে। নতুন দলের দুই শীর্ষ নেতাই বলেছেন, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন তারা।

একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, যদি নির্বাচন হয় এবং শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই হয়, তাহলে হয়তো বিএনপি আবারও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করবে। সে অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাদের নির্বাচনপ্রিয় নেতারা তৃণমূল বিএনপিতে এসে ভিড় করবেন। এমনকি বিএনপি নির্বাচনে গেলেও দলের মনোনয়নবঞ্চিতরা এই দলে এসে টিকিট চাইবেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেছিলেন, বিএনপির ভেতরে বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ আছে এবং সেই বিক্ষুব্ধ অংশটি তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। অর্থাৎ যারা মনে করেন বিএনপিতে তাদের অবস্থান নেই, ভবিষ্যতে রাজনীতি করার জায়গা পাবেন না, তাদের জন্য এই দল ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগে যাওয়া সম্ভব নয়। তৃণমূল বিএনপিতেই তাদের আসতে হবে। একই কথা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রশ্নটা হলো, যারা আওয়ামী লীগে মনোনয়ন পাবেন না, তারা কি তৃণমূল বিএনপিতে আসবেন? সময়ই বলবে সে কথা। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, নির্বাচনী নাটকীয় ঘটনা তত বাড়তে থাকবে। তৃণমূল বিএনপিকে সেই নাটকের বড় মঞ্চ বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি বা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। একেবারে বাম শিবির থেকে বিএনপি-আওয়ামী লীগ করা, এমনকি মৌলবাদী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার দৃষ্টান্তও আছে। কিন্তু সেসবের সঙ্গে আজকের একটা তফাত অবশ্যই আছে। যেভাবে একটা কঠিন এবং সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন এই দল এত ঢাকঢোল পিটিয়ে গঠিত হলো, সেটা বড় ঘটনাই। নির্বাচনে যদি এরা সব আসনে প্রার্থী দিতে পারে এবং জাতীয় পার্টিও যোগ দেয়, তাহলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না এলেও তার একটা অংশগ্রহণমূলক চেহারা থাকবে। যদি এই দলগুলো বেশ কিছু আসন বাগিয়ে নিতে পারে, তাহলেও আগামী সংসদের চেহারা হবে অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক।

ঘটনা বিচার করলে ছবিটা এরকমই হবে। আমরা বেশ বুঝতে পারছি রাজনীতি সামগ্রিকভাবে তার প্রকরণে, অনুশাসনে, কৌশলে এবং মূল্যবোধে একটা বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা দলীয় কার্যকলাপের মধ্যে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আগামী নির্বাচন শাসক দলের জন্য একটি প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করতেই হবে। তাই ছলেবলে কৌশলে কলেবর বৃদ্ধি এবং বিরোধী পরিসরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার আকাঙ্ক্ষা সেখানে তীব্র। বিএনপির সামনে বড় সংকট হলো টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা। সেই খরা কাটিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় দলটি। আওয়ামী লীগ চায় ধরে রাখতে। এ পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত এখন ময়দান। নির্বাচন করে ফেলা এবং সেই নির্বাচন যদি বিএনপিকে ছাড়াই অংশগ্রহণমূলক হয় তাহলে বিএনপিকে আরও একদফা ক্ষমতার বাইরেই থাকতে হবে। তৃণমূল বিএনপি মূল বিএনপিকে সেই চ্যালেঞ্জেই ফেলল বলে মনে হচ্ছে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেসির মায়ামিতেই অনুষ্ঠিত হবে কোপার ফাইনাল

জবির নতুন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর

ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের টানেল ধ্বংসে ইসরায়েলের ভয়ংকর কৌশল!

বিদেশিদের চাপ একেবারেই নেই : ইসি আলমগীর

না ফেরার দেশে ‘সিআইডি’র ফ্রেডি

সরকার আশ্বাস দিয়েছে বলেই নির্বাচনে এসেছি : জাপা মহাসচিব

এবার দক্ষিণ গাজা খালি করতে চায় ইসরায়েল

কবে আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত হবে জানালেন কাদের

নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

শুরু হলো এপিকটা অ্যাওয়ার্ড-২০২৩

১০

৬ ডিসেম্বর: লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত দিবস আজ

১১

বিতর্কিত জলসীমায় চীনের ১৩৫ জাহাজ!

১২

ছাত্রদল নেতাকে না পেয়ে ক্রীড়াবিদ ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার

১৩

জানা গেল হিরো আলমের বার্ষিক আয় ও সম্পদ বিবরণী

১৪

চাঁদপুরে মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে লড়বে ১১ প্রার্থী

১৫

জাতীয় অধ্যাপক ডা. আব্দুল মালিক আর নেই

১৬

প্রতারণায় মামলায় গায়ক নোবেলের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ জানুয়ারি

১৭

চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ ভাই নিহত

১৮

জিম্বাবুয়ের নির্বাচনে কারচুপি, জড়িতদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা

১৯

মিগজাউমের প্রভাবে লন্ডভন্ড ভারতের উপকূল, মৃত্যু ৮

২০
X